এখনো আছিস তুই এখনো আছিস
এক টুকরো আলো হয়ে অন্ধকার এ মিশে
যে কালে যে দেশে
মন্দির এ মসজিদ এ কাশী বা মেক্কায়
মরেনি মানুষ .
সে কাল সে দেশ থেকে ছেরেনি বন্ধন
যত খুন যত মৃত্যু যত অহংকার
আকাশ বাতাস ভরা যত হাহাকার
যত রক্ত লাল
শিরায় শিরায় নাচে
তারও চেয়ে শক্তিময়ী
এক বিন্দু বিশ্বাস
ধরেছে নিশ্বাস
ঘৃনা তাকে পারবেনা ছুঁতে ..
Wednesday, February 29, 2012
Monday, February 13, 2012
চিন্তামণির
চিন্তা
চিন্তামণি
মহা চিন্তায় পরে গেছেন । দেখতে দেখতে দশ বছর হল কর্ত্তা গত হয়েছেন। চিন্তামণির শরীর স্বাস্থ্য
বড়ই ভোগাচ্ছে। আজ বাতের ব্যথা, কাল পেটের ব্যথা, একটা না একটা লেগেই আছে ।আজকাল সব সময় শুয়ে
শুয়েই কাটান চিন্তামণি । ছেলেরা বড় হয়েছে, যে যার সংসার নিয়েই
ব্যস্ত ।
চিন্তামণির যে কি ভাবে সময় কাটে একা একা, সে নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই ।পেটের ছেলে শত্রু হয়েছে
সব । নাতী,
নাতনী অবশ্য ঠাম্মার ঘরে আড্ডা জমায়, কিন্তু তারাও কেউ সে অর্থে চিন্তামণির সঙ্গী নয় । এদের মায়ের সম্পর্কে
কোন মন্তব্য করা চলবেনা,
ফোঁস করে উঠবে । এক একটা ক্ষুদে শয়তান
।
ছেলের
বৌদের কথা না বলাই ভাল,
এক একটা এক এক রকম । বড় বৌ মালতী তবু যা
হক শাশুড়ির দেখাশোনা করে । শরীরে মায়া-দয়া আছে । তার খাওয়া দাওয়া, ওষুধ-পত্র ঠিক সময়
দিয়ে যায় । তাঁর কথা মত চলেও । চিন্তামণি থাকেনও তো বড়র সংসারে । কিন্তু কত্তার আমলের
সে দাপট আর নেই । অতবড় সংসারটা নিজে এক হাতে সামলেছেন এতকাল । এখন সবাই ভিন্ন ভিন্ন
সংসার পেতেছে । কোন সংসারের আর তাঁর কর্তৃত্ব চলেনা
এত
বড় বাড়ি, কত্তার ব্যাঙ্কের জমান এত টাকা সবই চিন্তামণির নামে । তবু দেখ সবাই কেমন
নিজের নিজের সংসার করে নিয়েছে। এত বিষয় সম্পত্তির দখল ছেড়ে একদিন টুপ করে চলে যেতে হবে কত্তার
মতন এই চিন্তাই তাঁকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে ।
মাত্র
ষাট বছর বয়েসে অমন একটা স্বাস্থ্যবান পুরুষ কেমন হটাত চলে গেলেন । কেউ কিছু বোঝার আগেই
সব শেষ । রাতের খাওয়ার পর চিন্তামণি তার পান-দোক্তা-পাতা নিয়ে বসেছেন, হটাত একটা ধুপ শব্দ শুনে ঘুরে দেখেন কত্তা মাটিতে পড়ে । ধর ধর, ডাক ডাক করে সবাই জড়ো হয়ে তাঁকে খাটে শোয়ান হল, ডাক্তার এসে নাড়ি ধরে বলেন সব শেষ । ভগবান সে অভিশপ্ত রাতের
কথা মনে পড়লে এখনও সারা অঙ্গে কাঁটা দেয় ।ডাক্তার বললেন কি যেন একটা নাম, হ্যাঁ ঐ সেরিবেরাল নাকি যেন; তিনি ঠিক সবসময় মনে
রাখতে পারেন না ।কি করেই বা মনে থাকবে তিনি তো আর বৌদের মতন লেখাপড়া শেখেননি
। অমন লেখাপড়া শেখার মুখে আগুন । দেমাকে মাটিতে পা পরেনা
এদের । সব সময় শাশুড়িকে নিচু চোখে দেখে এরা –ঠিকই টের পান তিনি । যদিও মুখে কেউ কিছু
বলেনি কক্ষনো। মেজবৌ মানসী কে সহ্য করতে পারেন না। এম এ পাশ আরও কি কি
পাশ, বড়লোক বাপের মেয়ে, তায় আবার কলেজের মাস্টারনী
। দেমাকে মাটিতে পা পরেনা । চিন্তামণিকে মানুষ
বলেই গ্রাহ্য করেনা । যখন চিন্তামণি হ’ক কথা গুলো প্যাটর
প্যাটর করে শোনান, নিরুত্তরে পাশ কাটিয়ে চলে যায় । একে কি বলে – অবজ্ঞা নয় ?
চিন্তামণি মানস চক্ষে দেখতে পান, গট গটিয়ে ছেলের কাছে গিয়ে বলছে –বাব্বা তোমার মার কথাবার্তা যেন কেমন, অশিক্ষিতের মতন । চিন্তামণি লিখে দিতে পারেন, এই কথাই বলে সে , নিজের কানে না শুনেও নিশ্চিত তিনি । মেজ ছেলে বিমান ও তো
দু-দণ্ড এসে বসে না মায়ের কাছে। যত গল্প ঐ বউয়ের সঙ্গে । যেন কপোত-কপোতী, দিন রাত বকম বকম- কি এত কথা আছে, মায়ের আলোচনা ছাড়া ।
নিজের
কচি বয়সের কথা মনে পড়ে যায় চিন্তামণির । কি ভালই না বাসত মানুষটা । বাড়ি থেকে বেরবার সময়
দরাজ গলায় “আসি গো ‘
আর ফিরে এসে –“কৈ গো,
কোথায় গেলে” ডাকে মন ভিজিয়ে দিতেন । অত বড় বড় ছেলে-বৌ সবাই
তো দেখেছে ।শেষ
দিনটি পর্যন্ত মাথায় করে রেখেছিলেন । ঐ একটা মানুষ চিন্তামণির সব সুখ হরণ করে নিয়ে চলে গেল ।মানুষটাকে সবাই ভালবাসত
। ছেলের বৌগুল এত আস্কারা তো তাঁর জন্যই পেয়েছে ।
একটা
মেয়ের বড় সখ ছিল ;কিন্তু হল তিনটেই ছেলে । কত্তা বলতেন তোমার
মেয়ে নেই তো কি, তিন তিনটে ছেলের বউ, অদের মেয়ের মতন ভালবাসা, দেখবে মেয়ের অভাব বোধ করবেনা । ঐ রকমই কথা বলতেন মানুষটা
। বউরা কে কি খেতে ভালবাসে, ডেকে ডেলে জিজ্ঞাস
করতেন, কিনেও আনতেন বাজার থেকে ।বলতেই হবে বউরা শশুরমশাইকে
খুবই মান্যি গণ্যি করত । আর কত্তা থাকতে চিন্তামণির কটুবাক্যগুলি বেমালুম হজম করে যেত
। কত্তা চলে যাবার পরে কেউ আর আমলই দিতে চায় না । থাকত একটা মেয়ে, চিন্তামণি দেখিয়ে দিতেন, কেমন করে মেয়ে মানুষ
করতে হয় । শুধু লেখাপড়া শিকলেই হল ? আর কিছু শিখতে হবে
না ! যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে –
কতবার বলেছেন ওদের শুনিয়ে । এই যে মেজ বউ, সারাদিন-তো কাজের অছিলায় বাড়ির বাইরে । সকালে শাশুড়ির চা-জলখাবার
করে দিয়ে, ছেলেকে স্কুলের জন্য তৈরি করত, বিমানের অফিসের জিনিস গুছিয়ে দিয়ে, চটি ফটর ফটর কলেজে । বিকালে ফিরেও ঐ চা-ছাড়া আর কোন কাজে হাত দিতে দেখেন নি । কি কত-গুল খাতাপত্তর
নিয়ে বসত , আর ছেলেকে পড়াত ঘটা করে । সব ছুতো, কাজ ফাঁকি দেবার, বোঝেন ঠিকই ।অতটুকুন ছেলে তাকে
অত পড়াবার কি আছে বাপু –আসল কথা সংসারের কুটোটি নাড়বেনা মহারাণী ।ঠাকুর-চাকরের অভাব
ছিলনা, তবু হাজার হোক বাড়ির বউ, সে যদি হেঁসেলে না
যায়, ভাল দেখায় কি! সারা শরীর জ্বলে যেত চিন্তামণির । এই বউটির কথাও বড় কাটা
কাটা ।
এই
তো সেদিন কি কথায় শুধু একটু বলেছেন- আমার আর কদিন। এর পরে তো সব তোমাদেরই
হবে। কি আর বলব আমার ভাগ্যটাই খারাপ। না হলে তিন তিনটে ছেলের
বৌ থাকতে আমার এই দশা হয় । মা বলে ডাকলেই তো আর হল না – মার মতন মনে করতে হবে। তোমাকে তো একটা কথা
বলার যো নেই – ফোঁস করে ওঠো। নিজের মার সঙ্গেও কি এভাবে কথা বল নাকি ? কি জানি বাবা তোমাকের কেমন শিক্ষা-দীক্ষা । এই তো আমার ছোট বোনের
মেয়ে কি সুশীল। শাশুড়িকে মাথায় করে রেখেছে। সাত চড়ে রা নেই । জামাইটিও পেয়েছে তেমনি
। সেদিন দেখি বোনের পা টিপে দিচ্ছে, বড় বাতের ব্যথায় ভোগে তো । তাদের দেখেও তো শিখতে
পার । আমার পোড়া কপাল ছেলে, বৌ কারো কাছে একটু
সেবা পাইনা । এমন ছেলে বউ থেকে মেয়ে-জামাই থাকা ঢের ভাল। বুড়ো বয়সে একটু সেবা পেতাম । এই টুকুন মাত্র বলেছেন, তার উত্তরে মেজ-বউ মানসী যা বললে শুনে থ মেরে গেলেন চিন্তামণি
। শুধু চিন্তামণি কেন, চিন্তামণির বাকি বোনেরা, আর ভাই হীরা-লাল – এরা মাঝে মাঝেই আসে
দিদির খোঁজ নিতে, এদের কাছে ছেলে-বৌ এর কথা বলে বুকের জ্বালা মেটান চিন্তামণি। সবাই তো শুনে অবাক
। গালে হাত দিয়ে ছোট বোন সুমতি বললে- বল কি গো, এই কথা বলল তোমায়, এত বড় সাহস । বলত যদি আমার বৌ এমন
কথা – দেখতে কি হাল করতাম। আমার ছেলের বৌ তো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস পায়না
। কি করবে বল,
তুমি ভাল মানুষ, তায় জামাইবাবু নেই । সবই অদৃষ্ট বুঝলে সবই কপাল ,
বুড়ো
হয়ে আজকাল চিন্তার খেই হাড়িয়ে যায় চিন্তামণির । আসল কথাটাই তো এতক্ষণ
মনে ছিলনা – হ্যাঁ মেজ-বৌ মানসী কথা শুনল চুপ করে- তার পরে বললে- যাই বল
মা, পরের মেয়ে যেমন আপন হয় না- পরের মাও তো আপন হয় না। আর তোমার অদৃষ্ট খারাপ
কি, তিনতিনটে বউয়ের একটি তো অন্তত তোমাকে দেখে ।ছোটো কলকাতার বাইরে, কি করেই বা সেবা করবে । আমাকে তোমার পছন্দ
নয়, কিন্তু দিদি তোমায় দেখে না এ কথা বলতে পারণা । অদৃষ্ট খারাপ তো আমার, আমার তো আর একটা বই শাশুড়ি নেই, তা সেই তুমিও আমায় দেখতে পারনা । তুমি কি আমায় নিজের
মেয়ে মনে কর, বলতো বুকে হাত দিয়ে । আর ছোটো মাসী মেয়ে ঝুমার কথা বলছ তো, সে তো এখানে এলেই শাশুড়ির চোদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে। আড়ালে যার এত নিন্দা
করে, লোকদেখানো আদিখ্যেতা করার কি দরকার । তোমার ছেলে বেশিবার
আমার মার কাছে গেলেই তো তুমি রাগ কর, ছোট-মাসীর জামাই কি
করে ভাল হয় তোমার কাছে,
বুঝিনা বাবা । যাই ওদিকে আবার টুটুনের
বাবার আসার সময় হয়ে গেল।
শোনো
কথা। কথার কি ছিরি । নিন্দা করবে নাই বা কেন। রুমার শাশুড়িকে তো
দেখেছেন চিন্তামণি। উঠতে বসতে খিচ খিচ করে। রূমা নেহাত ঠাণ্ডা
মেহে তাই চুপ থাকে। পড়ত যদি মানসীর পাল্লায়, দুদিনে ঠাণ্ডা হয়ে
যেত। অতটুকুন মেয়ে, শাশুড়ির মুখের ওপর
বলে কিনা তার কাছে শিখতে হবে মা হওয়া। নিজের মার কাছে এসে বসেনা, যে ছেলে, শাশুড়ির কাছে গিয়ে পরে থাকলে হ্যাংলা বলবেন না? কি আশ্চর্য।
বড়
বউ মালতী এখন চা দিয়ে গেল না কেন কে জানে।এই বয়সে এত শুয়ে থাকলে বাতে ধরবে যে ।এক সংসারে থাকতে মানসীর
হাতে সকাল বিকাল, সময় মতন চাটা পেতেন চিন্তামণি। চারটের সময় কলেজ থেকে
ফিরত মানসী, ফিরেই এক কাপ গরম চা করে এনে দিত। মেয়েটা কাজের কিন্তু
বড্ড ঢ্যাঁটা । নিজের সঙ্গে কোথায় যেন মিল খুঁজে পান মানসীর। যতই কেন মুখে রাগ করেন
ভিতরে ভিতরে তারিফ না করে পারেন না ।বলেন বটে মানসী এসে ছেলে বিমান কে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, মনে জানেন কথাটা যথার্থ নয় । বিমানটা তো চিরকালের
রগচটা আর একগুঁয়ে। ছোটবেলা থেকে তার যত কথা বাবার সঙ্গে । হোস্টেল থেকে চিঠি
দিত বাবাকে। তার কি চাই না চাই সব ফিরিস্তি বাবার কাছে । কতবার লিখেছেন চিন্তামণি-
তোমার যা যা দরকার আমাকে লিখে জানিও, আমি কিনে পাঠিয়ে দেব-কিন্তু
কোন দিন কি শুনেছে? বাবা-অন্ত প্রাণ ছিল ছেলের । কত্তাও বড় ভালবাসতেন
বিমান কে আর তার সঙ্গে মানসী কে ।
এই
এসেছে এতক্ষণে চা নিয়ে। বাবারে বাবা,
বসে বসে হাঁফ ধরে গেল। বড় বউ মালতী কাজে কর্মে
বড় ঢিলা। সকালে ঘুমের থেকে উঠতেই চায় না। বাড়িসুদ্ধ লোক উঠে
গেল, বউ পরে পরে ঘুমায়। প্রথম প্রথম বকাবকি করতেন চিন্তামণি- এখন আর কিছু বলেন না। সে দিনকাল আর নেই । ওর উপর ই তো ভরসা। নিজের শরীর স্বাস্থ্য
ঠিক থাকিলে কি আর এ সব অকর্মাদের মুখ চেয়ে থাকেন। ভগবান মেরে রেখে দিয়েছেন
সব দিক দিয়ে ।
এক
এক করে নাতী নাতনীরা ফিরছে স্কুল থেকে। পাঁচটা বেজে গেল বোধহয় । এখন আর সময়ের হিসাবও
থাকেনা চিন্তামণির। কত্তা বেঁচে থাকতে ঠিক সাড়ে পাঁচটায় বাড়ি ফিরতেন। গাড়ি ছিল অফিসের। ঘরের সঙ্গে এই লাগোয়া
বারান্দায় বসতেন দুজনে। কত্তার সঙ্গে আর এক কাপ চা খেতেন চিন্তামণি । সে সব সুখের দিন মনে
পড়লে চোখের কোনায় জল জমে যায়। এমন মানুষকে ছেড়ে একা পরে থাকতে হবে স্বপ্নেও ভাবেন নি। কার কপালে যে কি লেখা
আছে।
আজ
শরীরটা জুতের নেই ।দুপুরের খাওয়া মনে হয় বেশি হয়ে গেছে । গলার কাছটাতে কি যেন
আটকে আছে। পেট ভার। মাথাটা টিপ টিপ করছে
। দু-একবার ওকে উঠল যেন মনে হল । দু-পুরে ভাতের সঙ্গে
কি খেয়েছেন মনে করার চেষ্টা করলেন কিন্তু সে রকম কিছু খেয়েছেন বলে তো মনে পড়ল না। একটু নেমে বারান্দায়
এলেন চিন্তামণি । চেয়ার টেনে বসলেন ।মেজর ছেলে টুটুন কে দেখে কাছে ডাকলেন । কি রে- ওখানে একা একা
দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আর সব কোথায় , তোর দাদা, দিদি রা । টুটুন ঠোঁটে হাত দিয়ে ইশারা করল, তাই বল লুকিয়েছিস? তা আয় না আমার চেয়ারের
পেছনে লুকা, কেউ দেখতে পাবেনা ।হটাত মাথাটা কেমন ঘুরে উঠল মনে হলে । পিছন ফিরে তাকাতেই
চোখে আঁধার ।
চোখ
খুলে নিজের ঘর চিনতে পারলেন না চিন্তামণি ।কোথায় আছেন কিছু বুঝলেন না। ঘরে একটা হাল্কা নীল
আলো জ্বলছে । সরু খাট,
ঘরটা অচেনা, পাশে কেউ বসে আছে চেয়ার নিয়ে, নড়া চড়া করাতে কপালে
একটা ঠাণ্ডা হাত রাখল । অচেনা গলায় বলে উঠল, উঠবেন না, আপনি হাসপাতালে আছেন। হাসপাতালে ,
কেন আমার কি হয়েছে । আপনি মাথা ঘুরে পড়ে
গেছিলেন মনে আছে কি? আপনার একটা ছোট হার্ট অ্যাটাক হয়েছে । চিন্তা করবেন না, এটা ভাল নার্সিং হোম। ডাক্তারবাবু দেখে গেছেন, ওষুধ দিয়ে গেছেন । আপনি এখন ভাল আছেন। ঘুমিয়ে পড়ুন কাল সকালে
আপনার বাড়ির লোকেদের সঙ্গে দেখা হবে । আমার ছেলেরা আমাকে রেখে গেছে এখানে? ওরা সব বাড়ি চলে গেছে । আপনি এসেছেন এখানে
দু-দিন হল । এ দু-দিন,
রাত ছেলে বৌ সবাই ছিল , কেউ বাড়ি যায় নি। আজ আপনি ভাল আছেন দেখে ডাক্তার বাবু ওনাদের বাড়ি যেতে বলেছেন। ওনাদের ও তো বিশ্রাম
দরকার । চিন্তামণি আবার বালিশে মাথা নামিয়ে নিলেন ।
কখন
ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেছেন খেয়াল ছিল না। সকালে নার্সের ডাকে ঘুম ভাঙল ।তাদের কাজ-কর্ম সেরে
চলে যাবার পরে, ডাক্তার এলেন । বেশ ছেলেমানুষ হাসি-খুশি ডাক্তার । কেমন আছেন মাসীমা ? ভাল আছি বাবা- এক গাল হাসি চিন্তামণির । বাস আর কোন চিন্তা
নেই, আর সাতদিনে আপনার ছুটি । আরও সাতদিন? কেন বাবা আমি তো ভাল আছি । তা তো আছেন, কিন্তু আমাদের যে আরও কিছু কাজ আছে। কত-গুল পরীক্ষা করত
হবে ।কিছু
দিন অবসার্ভেসানে রাখতে হবে যে,
নাহলে তো আপনার ছেলেদের কাছে বকুনি খেতে হবে
। ডাক্তার হেসে বেড়িয়ে গেলেন । মাথা ঘুরিয়ে চিন্তামণি
দেখেন ঘরটি বেশ বড় আর ঘরে তিনি একা নন । আর একটি খাট পাতা আর তাতে এক বয়স্ক মহিলা, চিন্তামণির থেকে বেশ বড় বলেই মনে হল, শুয়ে আছেন । তার পাশে কোন আয়া বা নার্স দেখতে পেলেন না। নার্স সকালের খাবার
নিয়ে এলো । খাট সামান্য উঁচু করে দিয়ে পেটের সামনে একটা চৌকি পেতে দিল । তাতে প্লেটে, বাটিতে করে জলীয় খাবার । এটা কি, এ আমি খাইনা , আঁতকে উঠলেন চিন্তামণি
। নার্স সান্ত্বনা দেয় , আজ খেয়ে নিন , কাল থেকে শক্ত খাবার দেওয়া হবে আপনাকে । এটা পরিজ , আজ খেয়ে-নিন । যেন দশ বছরের মেয়ে কে বোঝাচ্ছে । মুখ ভার করে খেয়ে নিতে
হল । খাওয়া হয়ে গেলে, মুখ মুছিয়ে বেড়িয়ে
গেল মেয়েটা । এবার ভিসিটর্স আসবে, আয়া বলল । একটা ঘণ্টা বাজল । কিছু পরে ঘরে ঢুকল, ছোট-ছেলে আর বউ, সান্টু আর বুবু । এ কি রে তোরা- কবে
এলি ? এই তো কাল এসেছি ।তুমি যা কাণ্ড বাঁধিয়েছ না এসে কি করে থাকি । একেবারে হার্ট এটাক
করে ছাড়লে । কি এত চিন্তা তোমার মা ? ছেলে এসে জরিয়ে ধরল
। কতদিন পরে তোদের দেখলাম রে। শরীর খারাপের খবর পেয়ে
তবু তো এলি। আয় বস,
একটু ভাল করে দেখি তোকে । মা, ছেলের রকম দেখে আয়া মিটি মিটি হাসছিল । কিছু পরে ছোট বলল এখন
আমি নিচে যাই মা- তোমাকে দেখার লম্বা লাইন ।একে একে বড়,
মেজ, নাতীরা সবাই এলো । একটা দুটো কথা সবার
সঙ্গেই বললেন চিন্তামণি ।মনটা সামান্য ভাল হল । বার বার করে বলে দিলেন, ঠিক ঠাক ভাবে থাকিস সব। আমি বাড়ি নেই, কি জানি কি করছিস সব ।সংসার আলাদা হলে কি
হবে, বাড়ি তো এক,
তিনি এ ফ্ল্যাট ও ফ্ল্যাট করে বেড়ান শরীর
ভাল থাকলে । ওরা তো সবাই দিনে একবার অন্তত ঘরে এসে দেখা করে যায় । একা একা মন মানেনা
এখানে । আরও কত দিন থাকতে হবে কে জানে।
সকালে
বিকালে ভাগ করে ছেলে বৌ আসছে । ছোট ছেলে চলে গেছে ব্যাঙ্গালোরে, চাকরীর যায়গা- কতদিন আর ছুটি নেবে । মা ভাল আছে দেখে গেছে
। কিন্তু বড় আর মেজ বৌ পালা করে সকালের আর রাত্রের খাবার ঠিক নিয়ে
আসে বাড়ি থেকে । চিন্তামণির খাওয়া নিয়ে বড় পিটপিটানি, ওরা জানে । আজ শনিবার –কলেজ ছুটি । মানসী দুপুরের খাবার নিয়ে এসেছে । টিফিন কারিটা আয়ার
হাতে দিয়ে বসেছে পাশে ।চিন্তামণি আয়াটিকে একটু ঘুরে আসতে বললেন । সে যেতে মানসী কে বললেন-
আমাকে দোকান থেকে একটা পান এনে দেবে আর একটু দোক্তা পাতা ।মানসী বলে উঠল –তার চেয়ে তোমার জন্য এক চিমটে বিষ নিয়ে আসতে বললেই পারতে মা
। শোনো কথা- দোক্তা পাতা খেলে কেউ মরেনা মানসী । কেউ মরে কিনা জানিনা
। তুমি এখন দোক্তা-পাতা পাবেনা । শুধু পান বলত এনে দিচ্ছি
। প্রবল বিরক্তি চেপে চিন্তামণি রাজি হলেন । মানসী বেড়িয়ে যেতে
পাশের বেডের দিকে তাকালেন । দেখলেন দিদি,
দেখলেন। কি কপাল করেই এসেছি
। পাশের রুগীনিটি এতদিনে কিছুটা সুস্থ হয়েছেন । এতদিন স্যালাইন দেওয়া
ছিল । কাল রাতে খুলে দিয়েছে । উঠে বসেছেন আজ । উত্তরে দিদিটি স্মিত
হাসলেন । তারপর বললেন আপনার মেয়ে ? কি যে বলেন মেয়ে কি-এ
টি মেজ ছেলের বউ । দিদিটি আশ্চর্য হলেন । তাই নাকি আমি তো ভেবেছিলাম
মেয়ে। সত্যি বোঝা যায়না একেবারে । আপনি ভাগ্যবান । অবাক হলেন চিন্তামণি
। তার পরে কি মনে হতে বললেন – দিদি আপনার কাছে কারুকে
আসতে দেখি না যে ? ছেলে মেয়ে এখানে থাকেনা বুঝি ? দিদিটি একটা চাপা শ্বাস ফেললেন । আছে বৈকি , দু ছেলে,
দু বৌ, দুই নাতি – সবি আছে ।এখানেই আছে ,
কলকাতায় । চিন্তামণি তাকিয়ে রইলেন
। তারা আসেনা কেন জানতে চাইছেন তো ? তারা আসবেনা – আমাকে তারা ত্যাগ করেছে
। মানে । মানে আমি এখন একটা বোঝা, যেটা কে তারা আর টানতে
রাজি নয় ।
চিন্তামণি
সাবধানে জিজ্ঞাসা করলেন- ওদের বাবা বুঝি সেরকম কিছু রেখে যাননি।
রেখে
গেছেন বৈ কি। বাড়ি,
টাকা, গহনা সব রেখে গেছেন
। ওদের বাবা অনেকদিন ভুগেছিলেন ।সে সময় আমাকে জিজ্ঞাসা
করেছিলেন, সুধা আমি মনে হয় আর বেশী দিন নেই । যদি বল তোমার নামে
সব লিখে দিই। ছেলেরা রইল তোমার যাবার সময় ওদের সমান ভাবে ভাগ করে দিও । আমি রাজী হইনি দিদি
। বলেছিলাম ওসব বিষয় সম্পত্তির ঝামেলায় আমার ফেলনা তুমি । আমার ছেলেদের আমি বুক
দিয়ে মানুষ করেছি –ওরা আমার দু-চোখের মনি । তুমি ওদের ভাগ করে
দাও। আমি দুজনার সঙ্গেই থাকব, মাকে তো আর ভাগ করা
যায় না । তখন আমার কথা শুনে অন্তরীক্ষে ভগবান হেসেছিলেন আমি বুঝিনি ।বাবা যাওয়ার বছর খানেকের
মধ্যে দুই ভাই ভিন্ন হল । আমাকে নিয়ে তাদের বড় জ্বালা । দুই-বউ ঝগড়া শুরু করল, এবলে আগে তুমি রাখ, ও বলে আগে তুমি রাখ
। যদিও বা সে সমস্যা মিটল, বড় ছেলের কাছে ছমাস, তো ছোট ছেলের কাছে ছ মাস , কিন্তু অপমানের ভাত
আমার আর হজম হলনা দিদি । আমি বললাম আমাকে নিয়ে তোদের এত সমস্যা তো আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে
দিয়ে আয় । দু-জনে এক পায়ে খাড়া । এ দুঃখ রাখার জায়গা
নেই দিদি, কারুকে বলতেও পারিনা, সহ্যও করতে পারিনা
। বুকটা ফেটে যায় আমার । আপনাকে দেখে আমার বড়
ভাল লাগে । ভাবি আমার মনে নিশ্চয় ময়লা ছিল, বউদের নিশ্চয় আমি ভাল মনে নিতে পারিনি, নাহলে ভগবান আমাকে এত বড় শাস্তি কেন দিলেন ।দিদিটি আঁচলে মুখ চাপা
দিলেন । হতভম্ব চিন্তামণি চিন্তাশক্তি রহিত হলেন । এমনও হয়- পৃথিবীতে
এমন সন্তানও জন্মায় যাদের কাছে মা বোঝা , এ কি শুনছেন তিনি ।
কত্তা
বেঁচে থাকতে জিজ্ঞাসা করতেন “তোমাকে রাজরানী করব বলেছিলাম, করতে পেরেছি তো?” সোহাগে আহ্লাদে বুকের মধ্যে ফুলে ফুলে উঠত আর মনে হত পৃথিবীতে
আমার মতন সুখী কে আছে। আজ হটাত সেই সুখ বুক ঠেলে উঠল ।আনন্দে, গরবে চোখের কোনা ভিজে ভিজে । চিন্তামণি সে জল বালিশে
পরতে দিলেন । এ আনন্দাশ্রু; হৃদয়কে শুদ্ধ করেছে
।
মা
এই নাও তোমার পান। চমকে তাকালেন চিন্তামণি । হাসি মুখে মানসী দাঁড়িয়ে
।দাও
মা দাও চিন্তামণি হাত বাড়ালেন । তিনি লক্ষ করলেন না তার আদরের সম্বোধনে বিস্মিত মানসী চেয়ে আছে
নির্মিশেষে । মানসী পাশে বসে চিন্তামণির কপালে হাত রাখল । চুলে বিলি কেটে দিতে
দিতে নরম স্বরে জিজ্ঞাসা করল –
মা তোমার চুল বেঁধে দ