Thursday, February 4, 2010

সমুদ্র- হৃদয়

বিশ্বনাথ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দাঁড়াল মালতী সেনের কিউবিকেলের সামনে । বলতো মিলিদি এবার কাকে প্রধাণ অতিথি করে আনছি; তুমি ভাবতেও পারবেনা । কমপুটারের খোলা স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়ে , সামান্য বিরক্তি প্রকাশ করে মালতী- কেন কাকে আনছিস - আমিতাভ না কি শাহরুখ খান ! কিন্তু বিশ্বনাথ দমবার ছেলে নয়, ছেলেটার অফুরন্ত প্রাণ শক্তি; এতই উচ্ছল, চঞ্চল যে তার উপর রাগ করে থাকা যায় না।

উঁহু হলনা, বললাম না তোমাদের তাক লাগিয়ে দেব। এবার প্রধান অতিথি বিজন রায় দি গ্রেট। কলকাতার ভ্যান গগ - কি ভুল বললাম ? মালতীর শীল্প প্রীতি কারু অজানা নয় এখানে । মালতী মাথা নামিয়ে গভীর মনজোগে তার সামনে খোলা ফাইলে চোখ রাখে ।বুকের ভিতর দামাম বাজছে যেন । কিশোরি মেয়ের মতন রাঙ্গা হয়ে ওঠে মুখ । বিব্রত মালতী কি করবে, কি বলবে, কোথায় মুখ লুকাবে ভেবে পায়না ।


মালতী কে বাঁচায় দীপ্তেন্দু । নিজের জায়গা থেকে চেঁচিয়ে ডাকে - এইযে বিশু খুব তো ভ্যানগগ ভ্যানগগ করছিস, প্রধান অতিথি হলেই চলবে, আর আর্টিস্ট লাগবে না। লোকে গান শুনতে আসবে অনুষ্ঠানে , প্রধান অতিথি রাখ ; আরতি না করে দিয়েছে শুনেছিস। ঐ টাকায় হয় না । নতুন আর্টিস্ট ধর । এখন তো ডুপ্লিকেটের যুগ । তাড়াতাড়ি যা - না হলে অনিক ও ফস্কে যাবে । মালতী হাঁফ ছেড়ে বাঁচে ।


স্বপ্নের জগতের মানুষ মালতী। সমুদ্র তাকে টানে । সমুদ্রের গভীরতা, তার গাম্ভির্য, তার উদ্দাম উদাসীনতা মালতীর ভালবাসার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখে । এই কঠিন বাস্তব জগতে ভালবাসার মতন কোমল, অবাস্তব স্বপ্ন বার বার ভেঙ্গে যায় কাঁচের ঘরের মতন। গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলে মালতী ।
******

মিলি, তোমার ভার আমি নিতে পারবনা, তুমি জানো। বল জাননা ! কেমন একটা রুক্ষ স্বরে বলে অঠে বিজন। বালির উপর পিঠ করে থাকা মালতী কোনো উত্তর করে না ।


তুমি তো জান আমি ছন্নছারা, ঘরছারা, বাউল । এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকতে পারিনা আমি । ঘর , সন্সার আমার জন্য নয়। আমি তোমায় সাথে নিয়ে চলতে পারবনা । আমার জীবন, আমার তাত্মা, আমার সবকিছু আমি আমার সৃস্টির জন্য সরিয়ে রেখেছি মিলি, সেখানে তোমার কোনো জায়গা নেই । মিলি, মিলি শুনছ ।

মিলি তার ডান হাতটা বিজনের বুকের বাঁ-দিকে রাখে আস্তে করে , যেন ওজন করছে । মিলির তোখের দিকে তাকিয়ে বিজনের কথা থেমে যায় । সহসাই যেন মিলির দৃষ্টু বিজনের একেবারে বুকের ভিতর প্রবেশ করে তার চলাটা একেবারে থামিয়ে দেয় একটা ব্যাথার মতন আনন্দে তার হৃদয় শিউরে ওঠে । মিলি বুঝতে পেরে হাসে ।

সমুদ্রের এক একটা ঢেউ যেন আরো কাছে এসে যাচ্ছে । এই ঘন বর্ষায় খ্যাপা মিলির টানে সমুদ্রের তীরে ছুটে আসা বিজন মিলির চোখের গভীরে হারিয়ে যায় - 'কি চাও মিলি, কি চাও আমার কাছে;' মনে মনে বলে বিজন ।স্টুডিওতে রাখা ক্যানভাস, তুলি , রঙ, কিছুই এই পাগল করা, বুক থমকে দেওয়া চোখ-দুটোকে ধরতে পারে না। অনেক চেষ্টা করেছে বিজন। ঠিক এমনি একটা ছবি আঁকবে যা দেখে দর্শক হৃদয় ঠিক তারই মতন থমকে যাবে ।- তা হয়না বিজন। ছবির আমি আর তোমার আমি কি এক !'

ভীষণ ভাবে চমকে উঠল বিজন। মিলি কি তার মনের কথাও শুনতে পায়। মিলির শরীরের ছোটোছোটো ঢেউগলো কাছে টানে বিজঙ্কে। ভীষণ আকুল হয়ে বলে ওঠে বিজন- মিলি চল ফিরে যাই। চোরাবালির মধ্যে দুজনে হারিয়ে যাব। শেষ হয়ে যাব দুজনে চিরদিনের মতন। তাই কি চাও তুমি!

বিজনের চিবুকের ভাঁজ একটা আঙ্গুল রাখে মালতী- চোরাবালি নয় বিজন- আমরা দুজনে দুজনের মধ্যে হারিয়ে যাব। যেমন সমুদ্রের ঢেউ সমুদ্রের মধ্যে হারিয়ে যায়, আবার ওঠে, আবার হারায়। ঠিক তেমনই করে নতুন নতুন করে হারাব দুজনে দুজনের মধ্যে। চেয়ে দেখ বিজন এখানে তুমি আর আমি, ঐ আকাশ আর সমুদ্র। ঢেউ আর বালি, মেঘ আর বৃষ্টি। আর কেউ নেই । চল আমরা আজ প্রথমবার হারিয়ে যাই।

কোথায় হারিয়ে গেলি আবার- সুদর্শনার ডাকে চমকে ওঠে মালতী, হাসে অল্প । ঘরি দেখে এবার, পাঁচটা বাজে। ্টেবিলের কাগজ গুছিয়ে উঠে দাঁড়ায় মালতী। সুদর্শনা ব্যাগ হাতে করেই দাঁড়িয়েছিল। দুজনে গল্প করতে করতে চাঁদনি চক মেট্রো স্টেশনের দিকে এগিয়ে যায়। পথে চেনা ফলওলার কাছে এক কেজি আম কেনে মালতী, যা দাম হয়েছে এবার আমের, তবু কেনে মালতী। বুলতু আম বড় ভালবাসে আর মেয়েঅন্ত প্রাণ মালতীর ।

দেখতে দেখতে সান্সকৃতিক অনুষ্ঠানের দিন এগিয়ে আসে। মালতীর অস্থিরতাও বাড়তে থাকে । বিজন কি এখনও তাকে মনে রেখেছে । তার কি মনে আছে এই সংস্থায় মালতী কাজ করে । গত বার বছরে কত কি পরিব্ররতন হয়েছে । মালতীর জীবনে বিমান এসেছে, এসেছে তাদের মিলিত সন্তান বুলতু । বিমান ও মালতীর বিবাহিত জীবন এক কথায় বলা যায় একটি বিপর্যয় । বিমান ও মালতী দু-মেরুর প্রতীক। মালতী কোমল , বিমান কঠিণ, মালতী ভালবাসে কবিতা, ভালবাসে শীল্প, বিমানের মতে কবিতা ভাবাবেগের ট্র্যাশ, শীল্প তার কাছে নিরর্থক । মালতীর প্রিয় গন্ধরাজ, বিমানের পিয় হুইস্কি । সন্ধ্যার পর যখন বিমানের ঘর্মাক্ত শরীর, নেশায় চুড় বস্থায় সোফার ওপর হাত-পা ছড়িয়ে পরে থাকে, মালতীর সারা স্বত্ত্বা যেন ঘৃণায় শিঊরে ওঠে । শরীর সর্বস্ব বিমানের কাছে মালতীর সুন্দর দেহ এক বিরাট আকর্ষন , কিন্তু মালতীর হৃদয় মানেনা । তার প্রাণের অর্ঘ সে অপাত্রে কেমন করে ঢালে ! মালতীর সমর্পন যে অপূর্ন, বিমানের মনে সে সন্দেহ ছুঁএ ছুঁয়ে যায়, কিন্তু এর কারন খোঁজার মতন ধৈর্য বা মানসিকতা কোনটাই তার নেই । এক অর্থে সে সুখী, কারন সে বোধহীন । দীর্ঘ বার বছরে বিমান আরো ভারিক্কী হয়েছে, আরো বেরসিক, আরো সুরাসক্ত, আরো নির্বোধ ।মালতীর জীবনের সব রঙ মুছে গেছে, নিভে গেছে চোখের আলো, ভালবাসার স্বপ্ন বিমানের রুক্ষ স্বভাবের কাছে এসে ভেঙে পরেছে । গত একমাসে বিন্দু বিন্দু জল পরে সে চড়াপরা ভাঙ্গা হৃদয়ে
একটা চেনা সুর ছুঁইয়ে যাচ্ছে । মালতী আবার হারিয়ে যাচ্ছে তার স্বপ্নের জগতে ।

আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে চিন্তা করছিল মালতী, কোন শাড়িটা পড়বে। বুলতু পাশে এসে দাঁড়ায়, তুমি লাল শিফন্টা পর মা। দারুন দেখায় তোমায়। হ্যাঁ, তোর মায়ের তো বয়স বাড়ছেনা কমছে, মন্তব্য করে বিমান । নিঃশ্বব্দে মালতী ঘন শ্যামলা সবুজ রঙের ঢাকাই শাড়িটা বার করে। সারা গায়ে মেরুন বুটি আর ঘন আঁচল। তার সঙ্গে বেছে নেয় মেরুন মিনে করা দুটো সোনার চুড়ি, একটা সরু সোনার চেনের সঙ্গে মেরুন মিনে করা লকেট আর , তেমনই একজোরা দুল । প্রসাধন শেষে যখন উঠে দাঁড়ায় মালতী, মেয়ে বুলতু আবেগে জরিয়ে ধরে মালতীকে। ওমা তুমি কি সুন্দর। মেয়েকে তাড়া দেয় মালতী। দেরী হয়ে যাবে যে, তাড়াতারি জামা ছেড়ে নে দেখি। দুজনেই যাবে কারন বিমান গান বাজনা শুনে সময় নস্ট করার পাত্র নয় । একটা ট্যাক্সি নেয় আজ মালতী। মেয়েকে নিয়ে যখন অনুষ্ঠান সভায় এসে পৌঁছয় তখন সভাপতির ভাষন শুরু হয়ে গেছে । বিশ্বনাথ ছুটে আসে- এত দেরী করে কেন । বিজন রায় এসে গেছেন । সবাই কত অটোগ্রাফ নিলো। বুলতুর মাথায় টোকা মেরে বললে- তোর মা একদম বোগাস। বিজন রায়ের মতন শিল্পীর কদর বোঝেনা । মা-মেয়েকে সামনের সারিয়ে দুট খালি চেয়ারে বসিয়ে দেয় ।

সভাপতির ভাষন শেষ হয়েছে। এবার প্রধান অতিথি বিজন রায়কে কিছু বলতে অনুরোধ করা হল। মালতী তাকিয়েছিল। মাইকের সামনে এসে দাঁড়াল বিজন। সেই চোখ, সেই নাক, সেই ঠোঁঠ, একমাথা চুল এখনও আছে। কিন্তু তাতে সাদার ছোঁয়া লেগেছে। খদ্দরের পাঞ্জাবী আর পাজামা গায়। বয়স বিজনকে ছুঁতে পারেনি। তেমনি ঋজু ভঙ্গি , ্সোজা, পাতলা চেহারা । বিজন রায় কি বললেন কিছু শুনতে পেলোনা মালতী। ওনার বলা বোধ হয় শেষ হয়ে গেছে। সবাই হাততালি দিচ্ছে। দেউ একজন ছুটে এসে সই নিল একটা । এবার স্টেজ থেকে নেমে চলে যাচ্ছেন বিজন রায়। মালতীর বুকের মধ্যেকার পাঁজর ভেঙ্গে যাচ্ছে । কিন্তু না বিজন রায় এই দিকেই আসছেন। মালতীর সামনে এসে দাঁড়াল বিজন। চোখের কোনায় হাসি। মুখ গম্ভির । তার হাতে একটা প্যাকেট। সেটা মালতীর দিকে এগিয়ে ধরে গম্ভীর স্বরে বলে বিজন- অনেক ধন্যবাদ। আপনার একটা প্রাপ্য ছবি আমার কাছে গচ্ছিত ছিল। আসলটা আমার কাছেই আছে । এটা তার নকল- সেটা দেখে আঁকা । এটা আপনার। যন্ত্রচালিতের মতন হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নেয় মালতী। বিজন রায় বেড়িয়ে গেলেন। সবাই এবার ঘিরে ধরে মালতীকে। বাবা, ডুবে ডুবে জল খাওয়া হচ্ছিল। তুমি তো আচ্ছা মহিলা। অমন একটা লোককে চেন, সে কথা বলনিতো । আরও কত কি। মেয়ে বুলতু মালতীর হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে খুলে ফেলে। একটা ছবি। বিশাল সমুদ্র আর আকাশের মিলন । তীরে বালুর উপর খোলা চুলে বসে এক রমনী। কি গভীর তার চোখের দৃষ্টি, কি আবেগ, কি মায়াময় । বুলতু বলে- ওমা ঠিক যেন তুমি মা, কিন্তু থেকে সুন্দর, আরো অনেক অনেক সুন্দর ।

হারানো ভুলে যাওয়া সমুদ্রের জোয়ার এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় মালতীকে, এই পার্থিব জগতের কাছ থেকে, সবার থেকে অনেক অনেক দূরে, এক সমুদ্র হৃদয়ে ।

No comments:

Post a Comment