বাসা
জুন মাসের সাত তারিখ হয়ে গেল , আকাশ গন গনে আগুনের মতন হয়ে আছে । বৃষ্টির কোনও চিহ্ন নেই । ভ্যাপসা দম বন্ধ করা গরমে ঘেমে বাস থেকে নেমে একটা আপাত স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম । যাদবপুর –গড়িয়া এলাকা টা আমার তেমন চেনা নেই । গত মাসে এসেছিলাম বাসা ঠিক করতে, তাই আন্দাজে নেমে পড়লাম । না: ভুল করিনি , বড় রাস্তা পার করে ডান দিকের গলিটাই রবি চ্যাটার্জ্জি লেন । এ রাস্তার শেষে ২৭ এ, নম্বর বাড়িটাই’ ‘শান্তির নীড়- আদর্শ বৃদ্ধাবাস । বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম । গতমাসে ভাল করে দেখা হয়নি । বাড়িটা বাইরে থেকে দেখলে একটা দেশলাইয়ের খোলের মতন মনে হয় । রঙ একটা কোনও সময় ছিল হয়ত এখন কিছু বোঝার উপায় নেই । ভিতরের দৈন্যদশা বাইরে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল । বুকে একটা ভার নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম ভিতরে । ফুটপাথ থেকেই উঠেছে ভিতরে যাবার দুটো সিঁড়ি, সদর দরজা খোলাই ছিল । ভিতরে ঢুকে, বাঁদিকে অফিস ঘর , একটা ভাঙ্গা টেবিল, চেয়ার জুরে বসে আছেন যিনি, তাকে দেখলে হটাত চমকে উঠতে হয় । এই জরাজীর্ণ পরিবেশে অনেকটাই বেমানান শ্রীমতী রেবা রায় , শান্তির নীড়ের কেয়ার টেকার । মহিলার বয়স চল্লিশের ওপারেই হবে, কিন্তু এখনো স্বাস্থ্য অটুট, মুখে আপ্যায়নের হাসি, পরিপাটি বেশ-বাস । এগিয়ে গিয়ে নমস্কার সেরে খাতায় সই করলাম । তার পরে কড়কড়ে চার হাজার টাকা গুনে ক্যাশ বাক্সে রেখে, রিসিট কেটে দিলেন । আমি মৃদু হেসে ঘর থেকে বেড়িয়ে এগিয়ে গেলাম পাঁচ নম্বর ঘরের দিকে । এদের এখানে মোট পনের জন বাসীন্দা আছেন । একটা ঘরে একজন, দু-জন বা চার-জন, এই ভাবে ভাগ করা । আমার মা একা ঘরে থাকেন । তার কারন চার জনের ঘর খালি নেই, আর এখানকার মালিক, খালি একজনের ঘর চারজনার ঘরের দামে আপাতত একজন কে ভাড়া দিয়েছেন ।
ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে গুছিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। ঘরের ভিতর একটা চৌকি, তাতে বিছানা , বালিশ পাতা । পাশে একটা কাঠের চেয়ার, একটা টেবিল, তাতে জলের জায়গা, গ্লাস আর কিছু টুক টাক জিনিষ , কোনের দিকে দেয়ালে পেরেক মেরে বাঁধা দড়িতে কাপড় ঝোলান, বুঝলাম এটা আলনার কাজ করছে । ঘরের ভিতর ঘুমোট গরম । দেয়ালের চুন খসে পড়েছে, কাঠের জানলা বন্ধ, উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম পাখাটা এত আস্তে চলছে যে হাওয়া নেই বললেই চলে।
মা বলল – রেগুলেটর খারাপ আছে, তুই জানলাটা খুলে দে , যাবার সময় বন্ধ করে দিস, সন্ধে হলেই ঝাঁক ঝাঁক মশা ঢুকবে ।
মা কাপড়টা দেখে মনে হল কত দিন কাচা হয়নি । বিছানার চাদর নোংরা, মাথার বালিশ তেল চিটে । আমার বুকের ভিতর টা চাপ চাপ লাগছিল । মা কেমন হাসি খুশি ছিল, একমাস আগেও । কি ফিটফাট, ধপধপে সাদা শারি । পরিপাটি চুল বাঁধা । বিছানা নিয়ে মা খুবই পিটপিটে বরাবর, চাদর, বালিশের ওয়ার, কাঁথা, কাচা ধোয়া ইস্তিরি করা না হলে মার ঘুম হতনা ।
কিন্তু আমার নিজের যা সামর্থ্য মা কে এর থেকে ভাল যায়গায় রাখতে পারবনা । যা মাইনে পাই, তার থেকে সংসার খরচ, মিনির স্কুলের খরচ, শিলার হাত খরচ, আর আমাদের নতুন কেনা বহুতলের ফ্ল্যাটের মাসের ইনস্টলমেন্ট দিয়ে আর যা বাকী থাকে তার থেকে এর থেকে দামী যায়গায় মাকে রাখা যেত না ।
আমি চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে পড়লাম । কি যে কথা বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না । মা জিজ্ঞাসা করল- কেমন আছিস ? মাথা নাড়লাম । তোর বৌ ? এবার ও মাথা নাড়লাম । মা কখনো শিলা কে নাম ধরে উল্লেখ করে না- সব সময় বলবে ‘তোর বৌ’ আর তাতেই শিলা ক্ষেপে লাল । মা আর শিলার এই ঝগড়ার বলি আমি । দু-জনার কাউকেই বোঝাতে পারলাম না শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা । মা বলবে ‘তোর বৌকে বোঝা । শিলা বলবে তোমার মাকে সহ্য করা যায় না । শেষ সে বেঁকে বসল, হয় মা না হয় আমি । তো আমি বললাম তুমি, কারণ আমি তো জানি, মা কে সরিয়ে দিলেও মা আমারই থাকবে । মা যে আমার একার মা, আমাকে ত্যাগ করবে না । মার জন্য বৌকে ছাড়া যায় না, নিজের মেয়েকে ছাড়া যায় না । অতএব ‘বৃদ্ধাবাস ‘।
মিনি কেমন আছে রে? ওকে নিয়ে এলে পারতিস , দেখতাম । মিনির কথা বলবার সময় মার শুকন, কঠিন মুখে একটা চাপা খুশীর ছায়া খেলে গেল । চোখদুটো স্বপ্নালু হয়ে উঠল । মিনি , আমার ছয় বছরের মেয়ে, দাদি বলতে অজ্ঞান । স্কুল থেকে ফিরেই দাদি, বকলে দাদি, রাত্রে দাদির কাছে না শুলে তার ঘুম হয়না, দাদি গল্প বলে যে । ও রকম গল্প মা বলতে পারেনা যে । যখন নাতনি আর দাদি গল্প করত মনে হত দুটি সম বয়সী বন্ধু যেন ।
এতে ও শিলার ভীষণ আপত্তি । মিনির কু-শিক্ষা হচ্ছে । এখন মিনির স্কুলের গরমের ছুটি, কিন্তু কাল শিলা মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে । এছাড়া কি বা উপায় । আমরা কি বলতে পারব কোথায় রেখে এসেছি তার দাদিকে । বলতে হয়েছে বেড়াতে গেছে খুব সুন্দর জায়গায় নিজের বন্ধুদের সংগে ।
সেকি দাদির নিজের বন্ধুও আছে । কৈ দেখিনি কেন কোনদিন ? কবে আসবে বাবা ? আমাকে কেন নিয়ে গেলনা ?
আছে বৈকি, তুই দেখিস নি । তোকে কি করে নিয়ে যাবে, তোর স্কুল না ! দিদিমণি বকবে যে । আসবে আসবে , এই তো কিছু দিন পরেই আসবে । মিথ্যা মিথ্যা আর মিথ্যা । কি জানি কত দিন চালাতে পারব এ ভাবে । শিলা বলে কিছুদিনেই ভুলে যাবে দাদিকে , শিশু তো , ওদের মনে থাকেনা । তাই তো , ঘরের কত পুড়ান আসবাব ফেলে নতুন নতুন কেনা হয়েছে ; সেই রকম পুড়ান দাদি সরিয়ে নতুন দাই-মা রাখা হয়েছে, যে গল্প বলে, স্নান করিয়ে দেয়, খাইয়ে দেয়, সব করে । পুড়ান ভাড়া বাড়ি ছেড়ে নতুন কেনা ফ্ল্যাটে এসেছি । একটা বড় ঘর, সেটাকে দিব্যি একটা কাশ্মীরি কাঠের পার্টিশন করে একপাশে সোফা সেট অন্য দিকে খাবার টেবিল পেতেছে শিলা । আরও দুটো ঘর আছে, তার সঙ্গে জোরা স্নানঘর ।একটা আমাদের, আর একটা মিনির ।হ্যাঁ ছোট্ট মিনির জন্য একটা আস্ত ঘর চাই, সংগে দাদি থাকলে চলবেনা । অভ্যাস খারাপ হয়ে যাচ্ছে । আর শিলার দৃঢ় বিশ্বাস মা সবার আড়ালে মিনির মনে নিজের মায়ের বিরুদ্ধে বিষ ঢোকাচ্ছে । পুড়ান বাবার আমলের আসবাব বিক্রি করে নতুন কেনা হয়েছে ।পুড়ান টিভি পালটে নতুন এল সি ডি টি ভি, নতুন পরদা, এক একটা ঘরে এক এক রকম রঙ, তাদের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে পরদা । আর আমি নামক পুড়ান ছেলেটা, এখন নতুন কেন্নো জন্ম লাভ করেছি , স্বামী হিসাবে ।
আমি কথা ঘোরাবার জন্য বললাম, তুমি কেমন আছ মা? তোমাকে দেখে ভাল লাগছেনা ? কত রোগা হয়ে গেছ এক মাসে। খাওয়া দাওয়া ঠিক হচ্ছে তো ? মা একথার কোনও উত্তর করলনা ।শুধু একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বেড়িয়ে এলো। কিছুক্ষণ নিঃস্তবদ্ধতায় কেটে যায় ।
শিলা কিছু জিনিষ রেখে গেছিল মার জন্য, বিস্কুট, মাথার তেল, আর কি কি, সে সব আমি টেবিল এ রেখে উঠে দাঁড়ালাম । মা বলল এখুনি যাবি ? আমি বললাম হ্যাঁ মা, পরের মাসে সময় নিয়ে আসব , আজ চলি । মা বলল –এখুনি যাবি? আচ্ছা আয় বাবা , দুর্গা দুর্গা । রাস্তা দেখে পাড় হবি । সাবধানে যাস, আর হ্যাঁ চলন্ত বাস থেকে নামিস না যেন ।
উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আমার হটাত মনে পড়ে গেল মিনি মামার বাড়ি যাবার আগে একটা খাম দিয়ে গেছিল দাদির কাছে পাঠাবার জন্য ঠিকানা লিখে ডাক বাক্সে ফেলতে। আমি বাগ খুলে খামটা খুলে দেখি একটা হাতে তৈরি কার্ড । দুটো লাল ফুল, দুটো সবুজ পাতা, মিনির নতুন রং-তুলির কাজ, ভেতরে কচি হাতে লেখা,
দাদি- তুমি শীগগির চলে এস-
তোমার জন্য আমার ভীষণ মন কেমন করছে
তোমার আদরের মিনি
আমি কার্ডটা মার হাতে দিলাম –
মার চোখ থেকে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে । দেখে আমার ভিতরের ছেলেটা জেগে উঠল । এই আমার মা, সারা জীবন বুক দিয়ে আমায় আগলেছে । বাবা মারা যাবার পরে একা হাতে সব বাধা পেড়িয়ে আমাকে এত বড় করেছে । আজ বৃদ্ধা, অসহায়,
পরিত্যক্ত আসবাবের মতন এখানে আমার সামনে । আমি হাত বাড়িয়ে মার হাতটা ধরে- বললাম ‘মা চল আমি তোমাকে নিতে এসেছি । আর এখানে তোমাকে থাকতে হবে না‘।
আমি বললাম কি? না কারণ একথা ভাবার সঙ্গে সঙ্গে আমার ভিতরটা কেন্নোর মতন গুটিয়ে গেল, আমার জিভ আড়ষ্ট , আমার ভিতর থেকে কে যেন আমাকে ঠেলে বাইরে বাড় করে আনল । আমি ছিটকে রাস্তায় বেড়িয়ে এসে পিছন ফিরে দেখলাম একবার । সরু বারান্দায় বসা কিছু বৃদ্ধ, বৃদ্ধা সাগ্রহে আমার দিকে দেখছেন । ভাবছেন তাদের ছেলে বুঝি, মাসের দেখাটা সারতে এসেছি ।
আমি আমার নতুন ঝকঝকে ফ্ল্যাটের কথা ভাবছিলাম, নতুন, সুন্দর, ঝাঁ চক চকে , কিন্তু সেটা কে কি বাসা বলা যায় !
Thursday, June 16, 2011
বাসা
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment