Monday, June 27, 2011

প্রায়শ্চিত্ত

শীতের উত্তুরে কনকনে হাওয়া থেকে বাঁচার জন্য সুধা গরম চাদরটা ভাল করে জরিয়ে নিলেন গায় । ষাট পেড়িয়ে গেছে তবুও সৌন্দর্য এখনো ছেড়ে যায় নি ..এক মাথা কাঁচা-পাকা কোঁকড়ান চুল, আলগোছে ঘাড়ের কাছে খোঁপা করে বাঁধা ।মাঝ খানে টান টান সাদা সিঁথির রাস্তা । ছোট্ট চাঁদের মতন কপাল ।পাতলা ভ্রু যুগলের তলায় মায়া মায়া স্বপ্নিল দুটি চোখ ।সেই চোখে তিনি নিচে চেয়ে আছেন, দেখছেন কি না কে জানে, দেখলে কি দেখছেন, কাকে দেখছেন, তাই বা কে বলতে পারে । নিচে রাস্তায় কেউ হাঁটছে, কেউ দাঁড়িয়ে কথা বলছে, শিশু, বৃদ্ধ , মাঝ বয়সী । সুধা স্বপ্ন দেখেতে ভাল বাসেন, ভালবাসেন কল্পনার জগতে বিচরণ করতে । তিনি সাদা, কালো, লাল, নীল, সবুজ নানা রঙের স্বপ্ন দেখেন, সেই স্বপ্ন কে কথার মালায় সাজিয়ে সৃষ্টি করেন কবিতা, সেই সব কবিতাই ঘিরে রাখে তাঁর জগত ।
কত বছর আগে, মনে হয় বছর চল্লিশ হবে, সুধা আর বিনোদিনী এমনি এক শীতের সকালে স্কুলের পথে চলেছিলেন একসাথে । দুজনার গায়ে নীল গরম জামার তলায় সাদা স্কুল স্কার্ট , কাঁধে ঝোলান স্কুল ব্যাগে । আর দু-দিন তার পরে স্কুল ছুটি হয়ে যাবে, বড়দিনের ছুটি । সুধার মনে হল, এখনকার থেকে সেসময় অনেক বেশী শীত পড়ত। বিনোদিনী স্কুলে নতুন । তার বাবা সরকারী চাকরী করেন, নানা জায়গায় বদলি হতে হয় । অনেক বড় চাকরি করেন, অনেক ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, মানে একজন কেউকেটা ।

বিনোদিনী কিন্তু ভারি সরল সোজা আর মিশুকে মেয়ে । তার কোন অহংকার ও নেই , এই যে তার বাবা এত বড় চাকুরে । স্কুলের সব মেয়ে, মায় দিদিমণিরা পর্যন্ত বিনোদিনীর গুণমুগ্ধ । সে স্কুলে আসার পর থেকে সুধার মন বড়ই খারাপ থাকে । এতদিন সুধা পড়াশুনায় সবচেয়ে আগে, প্রতি বছর প্রতি বিষয় প্রথম হতেন । শিক্ষিকা সবাই সুধাকে খুবই ভালবাসতেন, যেমন ভাল ছাত্র-ছাত্রীর ক্ষেত্রে হয়ে থাকে আর কি । কিন্তু দেখা গেল বিনোদিনী, সুধার থেকে সব বিষয়েই এগিয়ে থাকে । পরীক্ষায় সে বছর বিনোদিনী প্রথম, সুধা দ্বিতীয় । এমন কি খেলাধুলা তেও বিনোদিনী চৌকশ । সুধা তার নিজের জায়গাটা হাতছাড়া হতে দেখে মনমরা হয়ে থাকে । যতই চেষ্টা করুক বিনোদিনীকে হারাতে পারেনা সুধা । তবে সুধার একটা গুন বা সখ, সে বেশ সুন্দর ছড়া লিখতে পারে। সবাই ভালই বলে সে সব কবিতা পড়ে। সুধার বাবা বঙ্কিম রায় মশাই একটি প্রকাশনী কার্যালয়েতে কাজ করতেন । তিনি কথা দিয়েছেন সুধার কবিতার বই ছাপিয়ে দেবেন ।

সুধা বিনোদিনী একটু অহংকারের সঙ্গেই বললেন , জানিস তো আমার বাবা বলেছেন আমার লেখা কবিতা গুল নিয়ে একটা বই ছাপিয়ে দেবেন । সেখানে আমার ছবি ও থাকবে। অহংকার তো হবার ই কথা ।

সবাই তো আর ইচ্ছা হলেই ছড়া লিখতে পারেনা । তার জন্য আলাদা এলেম দরকার । মনে মনে নিজেকে সে অন্তত এ বিষয়ে বিনোদিনীর চেয়ে একটু উপরে বলে মনে করতে পারে ।

তাই বুঝি! বিনোদিনীর সুরে কি হিংসা ছিল না কি হতাশা ! ঠিক বুঝলেন সুধা ।

জানিস তোকে বলিনি, আমিও না কবিতা লিখি । সবাই বলে বেশ ভাল লেখা । বিনোদিনী বললেন । তার পরে একটু কুণ্ঠার সঙ্গে যোগ করলেন – তোর বাবা আমার বই ও ছাপিয়ে দিতে পারবেন ভাই !

সহসাই সুধা দ্রুত পা চালালেন , হতবাক বিনোদিনী কে পিছনে ফেলে, প্রায় দৌড়ে গেলেন যেন । কেন কেন, বিনোদিনী কবিতা লিখবে । স্কুলে এসে পর্যন্ত, সব বিষয়ে সুধাকে তার অর্জিত মর্যাদার আসন থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে । লেখাপড়া, খেলাধুলা, এমনকি এখন দিদিমণিরা বি্নোদিনীকে ই ক্লাস মনিটার করেন সবসময় । তার উপর সে কবিতাও লিখবে । কেন লিখবে, সেটা শুধু সুধার জন্য থাকুক, শুধু তার জন্য । যেমন করেই হক বিনোদিনীকে কবিতা লেখা থেকে নিরস্ত করতে হবে।

স্কুলে গিয়ে সুধা মাথা ঠাণ্ডা করলে চেষ্টা করেন । বিনোদিনীর সঙ্গে যেচে কথা বলে ব্যাপারটা হাল্কা করতে চাইলেন । যেমন নিজে থেকে তার কাছে তার কবিতার কথা জিজ্ঞাসা করা , এমনকি তার কবিতার খাতাও দেখতে চাওয়া । বিনোদিনীর সরল মন, লাল রঙ এর একটা বাঁধান ডাইরি আছে তার, চারপাশটা সোনালী বর্ডার । ভিতর মুক্তর মতন গোল গোল গোটা গোটা অক্ষরে কাল কালিতে কুড়িখানা কবিতা ।

সুধা বললে, সে খাতা যদি বাড়িতে নিয়ে যেতে দিস ,আমি বাবাকে দেখাব । বাবা হয়ত তোর লেখা ও ছাপিয়ে দিতে রাজী হবেন । কি বলিস !

বিনোদিনী তো অনন্দে আত্মহারা । সত্যি ! তুই কি ভাল রে । আজ থেকে তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড । দেখিস আমার বই আমি তোকে উৎসর্গ করব ।

সুধার চিন্তা-স্রোত ছিন্ন ভিন্ন করে বেজে উঠল টেলিফোনের ক্যানক্যানে শব্দ । এই সব কথা কত দিন আগে ঘটে গেছে, কিন্তু বার বার চিন্তা করে এদের স্মৃতি ঝক ঝক করছে সুধা অন্তরে, এই তো যেন সেদিনকার ঘটনা । বার বার যাওয়া আসা করে স্মৃতির রাস্তা যেন ছবির মতন স্পষ্ট, তার প্রতি আনাচ, কানাচ, প্রতি মোড়, প্রতি ঘটনা , অঘটন। জোর করে বর্তমানে ফিরে, ভ্রু কুঞ্চিত সুধার, কে আবার এই অসময় ।

দিদু, কি করছ? সেই তোমার জানলার ধারে ? আমার পুলওভার তৈরি হল । শিলার চিল কণ্ঠ দূরে রাখার জন্য সুধা টেলিফোন কানের থেক একটু দূরে নিয়ে গেলেন ।

আঃ, আস্তে কথা বলতে পারিস না ! হাল্কা একটা স্নেহের ছায়া খেলে গেল সুধার মুখমণ্ডলে ।না রে পাগলি, এখনো জোরা দেওয়া আর বোতাম বসান ও বাকি আছে ।

ওঃ দিদু, তাড়া তাড়ি কর । পরশু আমাদের স্কুল থেকে শিমলা নিয়ে যাচ্ছে । তার আগে চাই কিন্তু ।সুধার চোখের সামনে নাতনীর দুষ্টু-মিষ্টি চেহারা টা ভেসে উঠল ।

কাল আয়, পেয়ে যাবি ।
ঠিক !
ঠিক ,

পরের দিন সকালে বিনদিনি সুধার হাতে সমর্পণ করলেন তার সাত রাজার ধন এক মানিক, তার কবিতার খাতা ।
আমি বাবার কাছে দেব ।
ঠিক তো !
ঠিক।

সেদিন বাড়ি ফিরে সুধা চুপি চুপি বাবার ঘরে গেলেন । বাবা অফিস থেকে ফেরেন নি । বাবার ঘরে লেখার ডেস্ক আছে, সেখান থেকে কাল কালির দোয়াত হাতে সুধা তার বারান্দায় বসে বিনোদিনীর সখের কবিতার ডায়রি খুলে ঢেলে দিলেন কাল কালি পাতায় পাতায় । ধীরে ধীরে কাল কাল পিঁপড়ের মতন অক্ষর সব দোয়াতের কালির সঙ্গে মিলে মিশে একাকার । একটা কালিতে চোবান ডায়রি । কার সাধ্য কোন লেখা উদ্ধার করে । কালির দোয়াত যথাস্থানে রেখে, সেদিন খুব আরামের ঘুম ঘুমলেন সুধা ।

কি বলছিস তুই ! এ হতে পারে না ।বিনোদিনীর বিস্ফারিত চোখের দিকে তাকিয়ে অনায়াসে নিজের চোখে জল এনে ফেললেন সুধা । সত্যি বলছি, তোর গা ছুঁয়ে বলছি, বিশ্বাস কর আমি ইচ্ছা করে করিনি । বাবার ঘরে ডায়রি টা রাখতে গেলাম, কে জানত বল, যে কালির দোয়াত ঢাকনা খোলা আছে । আমার নিজেকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে । আমি কত বড় ক্ষতি করলাম তোর আমার নিজেকে একটা আস্ত খুনি মনে হচ্ছে। সুধার সুন্দর নিষ্পাপ মুখ দেখে কি কেউ বুঝবে, সে কতবড় মিথ্যাচার করছে । বিনোদিনীর নরম মন, সে নিজের দুঃখ ভুলে সুধা কে সান্ত্বনা দেয় । নারে তোর কি দোষ, এরকম তো হতেই পারে । সেদিন বিনোদিনী কিছুতেই কোনও বিষয়ে মন দিতে পারলেননা । যখন অঙ্কের দিদিমণি একটা শক্ত অঙ্ক দিলেন যেটা কেউ পারলনা, রোজকার মতন বিনোদিনী নিজে গিয়ে সে অঙ্ক সমাধান করার কথা ও বললেননা । সবাই খুব অবাক। বাড়ি ফিরে বিনোদিনী ঘরে ঢুকে সটান খাটের উপর আছাড় খেয়ে পড়লেন, সে কি কান্না তার। সুধা পরে জেনেছিল, বিনোদিনীর মা মেয়েকে কে আবার মনে করে করে লিখতে সাহায্য করেছিলেন । তিনি তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বুঝিয়েছিলেন, এটা তোর সামনে একটা পরীক্ষা মা, তুই চেষ্টা কর আবার তুই লিখতে পারবি। এত সহজে হার মেনে নিতে নেই জীবনে । জীবন লড়াই করে জিততে হয়।

বল হরি হরি বোল, বল হরি হরি বোল, দূর থেকে মৃতদেহ নিয়ে কাঁধে নিয়ে আসছে চার জন, তাদের পিছন পিছন আরও লোক জন খই ছড়াতে ছড়াতে যাচ্ছে। দূর থেকে কাছে এসে আবার দূরে মিলিয়ে গেল শবযাত্রা, ছড়িয়ে দিয়ে চলে গেল ধুপের তীব্র গন্ধ । এমন কি দোতলার জানলায় বসে সে গন্ধ এড়াতে পারলেন না সুধা ।

বল হরি হরি বোল বল হরি বোল, স্তব্ধ সুধার জীবন শূন্য করে মামা, কাকারা , বাবার মৃত দেহ, নিয়ে চলে গেল । সেদিন টিফিনের পরে সুধাকে বাড়ি নিয়ে এলেন শেখর কাকা। কেন তারা বাড়ি যাচ্ছে এত তাড়া তাড়ি, সুধা বার বার জিজ্ঞাসা করলেও কিছু তেই উত্তর পেলেননা । সেদিন রোজকার মতন খেয়ে দেয়ে অফিস যাবার জন্য বেড়িয়েছিলেন বঙ্কিম রায় মশাই । বাস স্টপে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মাথা ঘুরে পড়ে যান সেখানে । পাড়ার লোক চিনতে পেরে ধরাধরি করে বাড়িতে আনে, ডাক্তার ডাকে, কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ । মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে সম্পূর্ণ অনাথ হয়ে গেলেন সুধা ।বাড়িতে গিয়ে দেখেন উঠোনের উপর বাবার দেহ সাদা চাদরে ঢাকা । কেউ সুন্দর করে বাবার কপালে চন্দন পড়িয়ে দিয়েছে । দুখানি পা চাদরের তলা দিয়ে বেড়িয়ে রয়েছে । কেউ একজন সুধা কে নিয়ে এগিয়ে গেল- বাবাকে শেষ বারের মতন নমস্কার কর সুধা । সুধা বাবার পায়ে হাত ছুঁইয়েই চমকে হাত সরিয়ে নিলেন । বরফের মতন ঠাণ্ডা । বাবাকে যখন ওরা নিয়ে যাচ্ছে সুধার মনে হল তার জীবন শূন্য হয়ে গেল । এখন তার চোদ্দ বছর বয়স । মা তাকে জন্ম দিয়েই মারা ছেড়ে গেছেন, একবার চোখের দেখাও দেখেনি দু-জনে দুজনকে। বাবাই তার জীবনে সব , আর আছেন ঠাকুমা । ওরা যখন বাবা কে কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে, সুধার মনে চট করে একটা চিন্তা এলো, তার কবিতার বই আর কোনও দিন ছাপা হবে না । ঠাকুমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল সুধা ।

নিচে তাকিয়ে সুধা দেখেন পোস্টম্যান । দ্রুত পায়ে নিচে গিয়ে বাক্স থেকে চিঠি বার করলেন সুধা । সাদা লম্বা খামের ওপর তাঁর নিজের হাতে লেখা ঠিকানা, সুধারানী রায় বর্মন, ১৫ বকুল বাগান রোড, কলকাতা ৭০০০১৭ । খাম খুলে চিঠি পড়ে সুধার মুখে একটা বিচিত্র হাসি খেলে গেল । দু লাইনের চিঠি । প্রতি বার কবিতা লিখে প্রাকাশক/ সম্পাদকের কাছে পাঠানর সময় নিজে হাতে একটা সাদা খামে নিজের ঠিকানা লিখে পাঠাতে ভোলেন না সুধা ।

“প্রিয় সুধারানী দেবী, আমরা দুঃখিত আপনার কবিতা আমরা আমাদের পত্রিকায় ছাপাতে অপারগ । আমরা আশা করি ভবিষ্যতে ............ইত্যাদি”

উপর গিয়ে বাবার সেই পুড়ান দেরাজ খুলে চিঠিটা রাখলেন; একরাশ চিঠি পড়ে রয়েছে সেখানে, এমনই প্রত্যাখ্যানের চিঠি । সুধার প্রায়শ্চিত্তের চিঠি ।

এবার সুধা রোজকার অভ্যাস মত জানলা বন্ধ করে চেয়ারে বিনোদিনির নতুন লেখা কবিতার বই খুলে বসলেন । প্রায় প্রতি বছর বিনোদিনীর লেখা কবিতার বই প্রকাশ হয় নামকরা প্রকাশকের ছত্রছায়ায় ; আর প্রকাশ হওয়া মাত্র সে বই সুধারানী সংগ্রহ করেন নিজের তাগিদে ।

No comments:

Post a Comment