[The story coldly depicts a situation in which prisoners are condemned to death. Written in 1939, the story is set in the Spanish Civil War (in Spanish, the Guerra Civil), which began July 17, 1936, and ended March 28, 1939, when the Nationalists (known in Spanish as the Nacionales, elsewhere usually referred to as Fascists), led by General Francisco Franco, overcame the forces of the Spanish Republic and entered Madrid
An original translation of the story "The Wall" by Jean-Paul Sartre ]
প্রাচীর
আমাদের ঠেলা মেরে যে ঘরটায় ঢোকান হল সেটা বেশ বড় আর আলো ঝলমলে । অতো আলো আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিল । চোখ সয়ে আসাতে লক্ষ করলাম ঘরটার শেষ প্রান্তে একটা টেবিল এবং তার পিছনে চারজন লোক নাগরিক পোষাকে বসে কিছু কাগজ নাড়াচারা করছে ।দেখলাম এর আগেই আরো কিছু বন্দীর একটা দল সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে, আমরা ঘর পেড়িয়ে তাদের পাশে গিয়ে হাজির হলাম । দেখলাম এই দলটির কিছু বন্দী আমার পূর্বপরিচিত, কিছু একেবারে অচেনা এবং বিদেশী ।আমার সামনের সারিতে দু-জন গোল-মাথা, সাদা-চুল ওলা লোক ছিল তাদের এক-ই রকম দেখতে। মনে হল ওরা ফরাসী । ওদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বেঁটে লোকটা অনবরত তার পাজামার খুঁট ধরে টানাটানি করছিল- বুঝলাম, অপরিসীম স্নায়ু চাপে ভুগছে ।
প্রায় তিন ঘন্টা আমাদের চাটল লোকগুল আমার মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করছিল, যেন ঘিলুটিলু আর কিছু নেই, সব ফাঁকা । তবে ঘরের ভিতর বেশ গরম আর আরামদায়ক ।আগের চব্বিশ ঘন্টা আমরা শীতে হিহি করে কেঁপেছি শুধু । রক্ষীরা এক এক করে বন্দীদের টাবিলের সামনে দাঁড় করাচ্ছিল। সেই চারজন সকলের নাম আর পেশা জিঙ্গাসা করে ছেড়ে দিচ্ছিল; কিছু কিছু সময় দুটো-একটা প্রশ্ন করছিল , যেমন- আন্দোলোনের সাথে কি ভাবে যুক্ত ছিলে বা ৯ তারিখ সকালে কোথায় ছিলে, কি করছিলে ? ব্যাস ঐ পর্যন্ত- কারন এর উত্তর শোনার কোনো চেষ্টাও তারা করছিল বলে মনে হচ্ছিল না । কিছুক্ষন চুপচাপ শূণ্যে তাকিয়ে আবার কাগজে আমাদের ভাগ্য লিখতে শুরু করছিল । টমকে জিঙ্গাসা করল সে কি আন্তর্জাতীক- গেরিলা বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিল ? বেচারী টমের এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় ছিল না, কারন তার কাছ থেকে ইতিমধ্যেই এই সম্পর্কে কাগজ পত্র উদ্ধার হয়েছে । যুয়ান কে তারা কিছু জিঙ্গাসাই করল না, ওর নামটা শুনেই খাতায় অনেক কিছু লিখে ফেলল ।
যুয়ান বলল উঠল – আমার ভাই যোশুয়া ৮বিপ্লবী ছিল। কিন্তু ও আর এখানে নেই । আমি কোনো দলে নেই । আমি কোনো রাজনীতিও করিনা ।
লোকগুল তার কথার কোন উত্তর দিল না। যুয়ান আবার বলল “আমি তো কোন অন্যায় করিনি। আর একজন কি করছে তার জন্য আমি কেন শাস্তি পাব ? কথা বলতে বলতে যুয়ানের ঠোঁট কাঁপছিল । একজন রক্ষী তাকে টেনে সরিয়ে নিল ।
তোমার নাম প্যাবলো ঈব্বাইতা
হ্যাঁ
ওদের মধ্যে একজন আমার দিকে তাকাল –“ রামন গ্রস কোথায় ?”
আমি জানি না।
৬ তারিখ থেকে ১৯ তারিখ অব্দি তুমি তাকে তোমার বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিলে !
না ।
তারা কিছুক্ষন কাগজে কি সব লিখল; তারপর রক্ষীরা আমাকে বাইরে নিয়ে এল । বাইরে বারান্দায় যুয়ান আর টম দু-জন রক্ষীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। টম রক্ষীটাকে জিঙ্গাসা করল – “ কি হল এটা “
কিসের কি হলো ?
এটা কি জিঙ্গাসা-বাদ হোলো নাকি বিচার হয়ে গেল ?
বিচার – বলল রক্ষী ।
আমাদের নিয়ে কি করবে ওরা ?
রক্ষী বলল – তোমাদের জেলখানাতে ই শাস্তি শোনান হবে ।
আমাদের জেলখানাটা কার্যত একটা হাসপাতালের ঘর। এখন শৈত্যপ্রবাহ চলছে, তার জন্য ঘরটা অসম্ভব ঠান্ডা। আমরা সারা রাত ঠান্ডায় কাঁপলাম, দিনের বেলাতেও কোনো রেহাই পেলাম না শীত থেকে ।এর আগে পাঁচদিন আমি একটা মন্দির চত্বরে কাটিয়েছি-সেটা একটা বহু পুরাতন দেয়ালের গায়ে একটা ঘুপচি গর্ত বলতে যা বোঝায় কার্যত তাই। জেলখানা যত না তার থেকে অনেক বেশী বন্দী, তাই তারা আমাদের যেখানে পেরেছে ঢুকিয়ে রেখেছিল ।সে জায়গায় শীতে তেমন কষ্ট না পেলেও আমি একা একা হাঁপিয়ে উঠেছিলাম । এখানে অন্তত আমার সঙ্গী আছে ।যুয়ানের খুব-ই অল্প বয়েস আর অত্যন্ত ঘাবরে গেছে, তাই ওর কথা বলার মতন অবস্থা ছিল না। কিন্তু টম খুব কথা বলে আর ও স্পানিশ ভাষা বেশ ভালই জানে ।
ঘরটার মধ্যে একটা বেঞ্চি আর চারটে মাদুর পাতা ছিল । আমরা সেখানে নিঃশব্দে বিচারের অপেক্ষায় বসে রইলাম । একটা দীর্ঘ নীরবতার পরে টম বলল “আমাদের বাম্বু হয়ে গেল “
আমারও তাই মনে হচ্ছে, কিন্তু বাচ্চা ছেলেটাকে কিছু করবে না।
ওর বিরুদ্ধ্বে কিছু বলতে পারবেনা। ওর ভাই জংগী ছিল, ব্যাস ।
আমি যুয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, আমাদের কথা ওর কানে যাচ্ছে বলে মনে হলনা।
টম তখন কথা বলা থামায়নি। বলল “তুমি জানো ওরা সারাগসা তে কি করেছে? আমাকে সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা একজন মরক্কের লোক বলে ছিল, ওরা বন্দীদের রাস্তায় ফেলে তাদের ওপর দিয়ে ট্রাক চালিয়ে দিয়েছে। গুলি-গোলা বাঁচাবার জন্যেই করেছে শুনলাম ।“
কিন্তু এতে পেট্রল খরচ হছে তো। আমার ভীষন রাগ হছিল টমের ওপর; এখন কি এসব কথা বলার সমায় ।
ওদের লোকেরা রাস্তার ধারে ধারে দেখাশোনা করে আবার, আর আরামসে ধুমপান করে । ভেবনা যে একবারে মেরে ফেলে । ধীরে ধীরে কষ্ট দিয়ে মারে । যন্ত্রনায় ছট-ফট করে চিতকার করে ঘন্টার পর ঘন্টা আর ওরা মজা দেখে । লোকটা বলছিল, প্রথমবার ও বমি করে ফেলেছিল প্রায় ।
আমার মনে হয়না এখানে সেরকম কিছু করবে, যদিনা গুলিগোলা একদম শেষ হয়ে গিয়ে থাকে ।
ঘরটার ছাতে চারটে গোল গর্তমতন ছিল, যার ভেতর দিয়ে হাওয়া-বাতাস আসছিল, আকাশ ও দেখা যাচ্ছিল। গর্তগুলো বন্ধ করার জন্যে গোল গোল ঢাকনাও ছিল, কিন্তু মনে হয় লাগাতে ভুলে গেছে। এই গর্ত দিয়ে ঘরের ভিতর কয়লা ফেলে মনে হত আগে, আগুন জ্বালে ঘর গরম রাখার জন্য । গর্তের ঠিক নীচে অনেক অব্যাবহৃত কয়লার গুঁড়ো পরেছিল । হাসপাতাল থেকে রোগীদের সব সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, তাই আর গর্তের ডাকা গুলো দেওয়ার কথা কারু মনে নেই, ঘরে বৃষ্টি ও পরেছে অনেক দেখলাম । হু হু করে বরফের মতন ঠান্ডা হাওয়া আসছিল।
টম হি হি করে কাঁপতে শুরু করল শীতে । এই আবার সুরু হল বলে উঠে ব্যায়াম আরাম্ভ করল টম । হাত নাড়ানো আর শরীর ব্যাঁকানোর তালে তালে টমের জামা সরে সরে যাচ্ছিল আর আমি ওর ফরসা রোমশ বুক দেখতে পাচ্ছিলাম। মাটিতে শুয়ে পরে টাম পা তুলে সাইক্লিং করছিল, তালে তালে অর ভারী পাছা দুলে দুলে উঠছিল ।টমের চেহারা বেশ বড় সর কিন্তু বড্ড থল থলে । আমি মনে মনে কল্পনা করছিলাম টমের থল থলে নরম মাখনের মতন শরীরে কেমন ভাবে বন্দুকের গুলি বা ব্যেয়নেটে মতন ধারাল অস্ত্র ডুকে যাবে । টম এত মোটা না হলে এরকম চিন্তা আমার মাথায় আসতই না ।
আমার নিজের যে খুব একটা ঠান্ডা লাগছিল তা নয়, আমার ্কাঁধ থেকে হাতের আঙ্গুল অব্দি অবস হয়ে গেছিল । মাঝে মাঝে কিসের যেন অভাব বোধ করছিলাম। আমি অন্যমনস্ক হয়ে আমার গরম কোট টা খুঁজছিলাম , হঠাতই মনে পড়ল ওরা আমার কোটাটা ফেরত দেয়নি। আমাদের ভাল জামা , প্যান্ট সবই অরা নিয়ে নিয়েছে, মনে হয় ওদের সৈন্যদের মধ্যে বিলি করবে । আমাদের শুধু সার্ট আর হাসপাতালের রোগীদের পরার মতন সুতির ঢোলা পাজামা দিয়েছে । কিছুক্ষন পর টম উঠে আমার পাশে এসে বসল ।
শরীর গরম হল ?
কিছুমাত্র না, কিন্তু হাঁপিয়ে গেছি ।
আটটা নাগাদ একজন মেজর এল হাতে কিছু কাগজ-পত্র । আমাদের দেখিয়ে একজন রক্ষীকে নাম জানতে চাইল ।
স্টেনবক, ইব্বেতা আর মিরবল ।
চশমাটা ঠিক করে নিয়ে মেজর কাগজে চোখ বোলাল, “স্টেনবক—স্টেনবক, স্টেনবক, ও এই তো, তোমাকে কাল সকালে গুলি করে মারা হবে “ আরো খানিকটা দেখে বল্ল , হ্যাঁ তোমাদের দু-জনের জন্য ও একই শাস্তি ।
যুয়ান বলে উঠল – নানা এ হতে পারেনা । আমার এ শাস্তি হতে পারেনা ।
মেজর অবাক হয়ে যুয়ানের দিকে তাকাল – তোমার নাম কি বলতো ?
যুয়ান মিরবল ।
কিন্তু তোমার নাম আছে এখানে । তোমাকে মৃত্যু দন্ড দেওয়া হয়েছে ।
কিন্তু আমি তো কিছু করিনি- যুয়ান বলল।
মেজর কিছু না বলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে আমার আর টমের দিকে ফিরল ।
তোমরা বাস্কের নিবাসী ?
এখানে কেউ বাস্কের লোক নেই ।
বিরক্ত হয়ে মেজর বলল – আমাকে বলা হয়েছে এখানে তিনজন বাস্কি আছে । আমি তাদের খুঁজে বের করার জন্য সময় নস্ট করতে পারব না। তোমাদের তার মানে কোনো রকম পুরোহিতের সাহায্য লাগবেনা
আমরা কেউ কোনো উত্তর দিলাম না ।
আমরা একজন ডাক্তার পাঠাচ্ছি তোমাদের জন্য আজকের রাতটা তোমাদের সংগে থাকবে। মিলিটারি কায়দার সেলুট করে ফিরে গেল মেজর ।
কি বলেছিলাম আমি । আমাদের দিন শেষ ।
সত্যি , ছেলেটার জন্য এটা ্মোটেই ঠিক হলনা ।
যদিও সৌজন্যের খাতিরে বললাম কথাটা, কিন্তু আমার ছেলেটাকে একদম ই ভাল লাগছিল না ।এমনিতে ছেলেটার মুখটা বড্ড সরু মতন, তার উপর ভয় , আতঙ্কে চোখ-মুখ সব যেন বেঁকে গেছে । দিন তিনেক আগেও বেশ চালাক চতুর ছেলেটাকে আমার মন্দ লাগেনি, কিন্তু এখন ওকে দেখে একটা চিমষে বুড়ো মনে হচ্ছিল । এখন যদি ওকে ওরা নাও মারে, ছেড়ে দেয় তবুও আর কোনো দিন মনে হয় ও ছেলেবেলা ফিরে পাবে । ছেলেটার প্রতি করুনা করতে পারতাম হয়ত- কিন্তু আমি করুনা জিনিষ্টা তীব্র ভাবে ঘৃণা করি। ছেলেটা এখন চুপ করে গেছে, কিন্তু অর চোখ-মুখ, এমন কি হাত পর্যন্ত ফেকাসে হয়ে গেছে । গোল গোল চোখে স্থির দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল ছেলেটা । টমের মনটা খুব নরম, সে ছেলেটার পাশে বসে ওর হাত ধরে সান্ত্বনা দিতে যেতেই ছেলেটা মুখ বিকৃতি করে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিল ।
ওকে একা থাকতে দাও। দেখছনা ও এক্ষুনি কান্নাকাটি শুরু করে ফেলবে ।
অনিচ্ছর সঙ্গে টম ছেলেটার থেকে দূরে এসে বসল । যুয়ানকে সান্ত্বনা দিতে পারলে টম খুশি হত, নিজের কিছুটা সময় কাটত, তাতে করে নিজের পরিনতির কথা না ভেবে থাকতে পারত কিছুক্ষন অন্তত । আমি এর আগে কখন মৃত্যুর কথা ভাবিনি বা ভাবার অবকাশ হয়নি, কিন্তু এখন মৃত্যু আমার শিয়রে আর আমার সে কথা ছাড়া আর কিছু ভাবার ও নেই ।
টম আমাকে জিঞ্জাসা করল আমি কখন কারুকে খুন করেছি কিনা। আমার কাছে কোনো উত্তর না পেয়ে ও বলল টম নাকি এর আগে আগাস্ট মাসের সুরু থেকে ছ-জন কে হত্যা করেছে । টম আমাদের মৃত্যুর অনিবার্যতা অনুভব করতে চাইছিল না, মৃত্যু চিন্তা দূরে রাখার চেষ্টা করছিল । আমি নিজেও ঠিক মতন কল্পনাই করতে পারছিলাম না যে রাত পোহালেই আমরা গুলি বিদ্ধ হয়ে মরতে চলেছি । খুব কি ব্যাথা লাগবে, আমি ভাববার চেষ্টা করছিলআম আগুনের গোলা যখন আমার শরীর ফুটো করে বেড়িয়ে যাবে তখন কেমন মরণ যন্ত্রনা ভোগ করব । এ সবই কিন্তু ভাবের ঘরে চুরি- কারন সত্য একটাই- মৃত্যু আমাদের শিয়রে আর সেটাই একমাত্র সত্য; কিন্তু আমি শান্তই আছি ;সারাটা রাত পরে আছে সত্যের মোকাবিলা করার জন্যে । কিছুক্ষন পরে টম চুপ করে গেল, আমি আড় চোখে ওকে লক্ষ করছিলআম । দেখলাম যুয়ানের মতন টম ও ছাই এর মতন ফেকাসে মেরে গেছে , ওকে সাংঘাতিক বিচলিত দেখাচ্ছিল ; আমি মনে মনে বললাম এই সুরু হল ।ঘরের মধ্য খুবই অন্ধকার, ছাতের ফুটো গুলো দিয়ে আলো এসে পড়ছিল কয়লার গাদার ওপর যেন খোলা আকাশের নীচে একটা বিশ্রী দাগ । আমি ফুটোর মধ্য দিয়ে একটা তারা দেখতে পাচ্ছিলাম , বাইরে রাত্রিটা এখন নিশ্চয় পরিস্কার আর কন কনে ঠান্ডা ।
এমন সময় দরজা খুলে দু-জন রক্ষী একজন সাদা চুলো লোক কে নিয়ে ঘরে ঢুকল । লোকটা একটা বাদামী রঙ্গের পোষাক পরে ছিল । লোকটা আমাদের মিলিটারী অভিভাদন করে বলল –“ আমি ডাক্তার, শেষের এই সময়ে তোমাদের সাহায্য করব বলে এসেছি ।
লোকটার কন্ঠস্বর বেশ ভাল এবং ব্যাক্তিত্বপূর্ন । আমি বললাম – এখানে কি চাই ?
আমি তোমাদের জন্যই এসেছি । শেষের এই সময়টা যাতে তোমাদের কস্ট কম করতে পারি, তাই এসেছি ।
আপনি কেন এসেছেন । আরো অনেক ডাক্তার তো আছেন, হাসপাতাল তো ভর্তি ডাক্তার ।
লোকটা ভাবলেশহীন মুখে বলল – আমাকে এখানে পাঠান হয়েছে । তারপর তাড়াতাড়ি বলল “ও হো, তোমরা ধুমপান করবে ? আমার কাছে সিগারেট আছে, চুরুট ও আছে ।
আমাদের বিলাতী সিগারেট এগিয়ে দিল যদিও আমরা কেউ নিলাম না । আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছি দেখে লোকটা খেপে যাচ্ছে দেখলাম । আমি বললাম “ আপনি মোটাই আমাদের সাহায্য করার উদ্দেশে আসেন নি। তাছাড়া আমি আপনাকে জানি। যেদিন আমি গ্রেপ্তার হলাম সেদিন আমি আপনাকে ফ্যাসিস্টদের কর্মী আবাসে দেখেছি ।
আমি আরো কিছু বলব মনে করেছিলাম, কিন্তু সহসাই আশ্চর্য ভাবেই লোকটার সম্পর্কে সব কৌতুহল শেষ হয়ে গেল । সাধারনত আমি যার পিছনে পড়ি তাকে সহজে ছাড়ি না । কিন্তু কেন জানিনা আমার কথা বলার ইচ্ছাটাই হঠাত ই যেন ফুরিয়ে গেল । আমি শরীর ঝাঁকিয়ে অন্য দিকে চোখ ফেরালাম । হঠাত কি মনে হতে তাকিয়ে দেখি, লোকটা একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে । রক্ষী দুজন মাদুরে বসে ছিল । পেড্রো , রোগা , লম্বা লোকটা তার আঙ্গুল মটকাতে ব্যাস্ত, আর অন্য জন মাঝে মাঝে মাথা নেড়ে ঘুম তাড়াচ্ছিল ।
পেড্রো জিঞ্জাসা করল – আগুন লাগবে ।সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল । আমার মনে হল লোকটা একটা মোটা কাঠের মতনই নীরেট, কিন্তু খুব খারাপ লোক বলে মনে হয় না । ওর শীতল, নীল চোখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল কোনোরকম কল্পনাশক্তির অভাবই ওকে এমন বিরক্তিকর করে তুলেছে । পেড্রো ইতিমধ্যে বাইরে গিয়ে একটা লম্ফ নিয়ে বেঞ্চের একপাশে রেখেছে । খুবই কম আলো , তবু নাই মামার থেকে কানামামাও ভাল। কাল আমাদের সম্পূর্ন অন্ধকার ঘরে রেখে গেছিল । বহুক্ষন আমি একাগ্র ভাবে ঘরের ছাতে লম্ফের আলোর গোল প্রতিবিম্ব দেখছিলাম। আমি মনে হয় আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ।হঠাত চমকে উঠে দেখলাম সেই গোল অলোর বলয়টা অদৃশ্ব হয়ে গেছে, আর জাগরনের আলোয় আসন্ন মৃত্যু আমার সজ্ঞায় সঙ্গায় আমায় যেন পিষে ফেলল ।
মৃত্যু বা ভয় নয়, এ অনুভুতিটার কোনো নাম নেই ।আমার কপাল ,গাল যেন জ্বলছিল, মাথা টা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে যেন । আমি নিজেকে একটা নাড়া দিয়ে আমার দুই বন্ধুর দিকে চাইলাম । দু-হাতে মুখ ঢেকে টম বসে ছিল । আমি ওর মোটা আর ফরসা ঘারটা দেখতে পাচ্ছিলাম । বেচারী যুয়ানের অবস্থা আরও খারাপ । মুখ হাঁ করা, নাকের পাটা দুটো থর থর করে কাঁপছে । অদ্ভুত একটা শীতল চাউনি নিয়ে ডাক্তার উঠে গিয়ে তার পিঠে হাত রাখল , তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য । তারপর লক্ষ করলাম ডাক্তার সাবধানে তার হাত নামিয়ে এনে যুয়ানের স্নায়ু চেপে পরীক্ষা করছে, যদিও যুয়ান কিছুই খেয়াল করছিলনা । ঐ অবস্থাতেই ডাক্তার আমাকে আড়াল করে পকেট থেকে একটা ঘড়ি বের করে স্নায়ু চাপ মেলাচ্ছিল । আমি অবশ্য দেওয়ালের দিকে সরে গিয়ে তার সব কাজকর্মই লক্ষ করছিলাম । লোকটা নিজের জায়গায় ফিরে এসে বসে পড়ল আর হঠাত যেন কি ভীষন দরকারি কথা মনে পড়েছে যেটা এক্ষুনি লিখে রাখতে হবে এমন ভাব করে পকেট থেকে একটা ছোটো খাতা বার করে কিছু লিখল ।“শালা হারামী, আসুক আমার কাছে আমার স্নায়ু চাপ পরীক্ষা করতে , বেটার কদর্য মুখে ঘুষি ঢুকিয়ে দেব “।
লোকটা আমার কাছে না এলেও আমি বুঝতে পারছিলাম আমাকে লক্ষ করছে ; আমি মাথা তুলে ওর দিকে তাকালাম । “তোমার মনে হচ্ছেনা বেশ ঠান্ডা এখানে ।“ অকে দেখে মনে হচ্ছিল খুব শীত করছে, ঠান্ডায় নীলচে হয়ে গেছে ।
আমার ঠান্ডা লাগছেনা মোটেই – বললাম ।
লোকটা আমার থেকে তার দৃষ্টি সরাচ্ছেনা কেন আমি যেন হঠাতই বুঝতে পারলাম আর আমার হাতটা নিজের থেকেই আমার মুখে চলে এল ; আমি ঘামে ভিজে জব জব করছি । এই ঘরে, ভয়ানক শীতে, শৈত্য প্রবাহের মধ্যে আমি ঘামছি ।আমার চুল ঘামে ভিজে আঠা আঠা হয়ে গেছে, হাত চালান যাচ্ছেনা, জামাটা ভিজে গায়ের সংগে সেঁটে গেছে ; গত একঘন্টা ধরে আমি দরদর করে ঘামছি, অথচ কিচ্ছু বুঝতে পারিনি ।কিন্তু এই শালা শুয়ারের চোখে কিছুই এড়ায়নি । আমার গাল বেয়ে ঘাম ঝড়া দেখছিল আর ভাবছিল, এটা হচ্ছে চরম আতঙ্কের বহিঃপ্রকাশ, এমনটাই পড়ায় ডাক্তারি বইতে । নিজের শীত করছে বলে ভাবছিল, ও কতো স্বাভাবিক আছে, কারন ওর মৃত্যু ভয় নেই । একবার ভাবলাম উঠে দাঁড়িয়ে বেটার মুখ ভেঙ্গে দি, কিন্তু সামান্যতম শারীরিক পরিশ্রমেই আমার রাগ, ঘৃণা দূর হয়ে গেল , আর কিছু করবার স্পৃহাই হলনা ,আবার তক্ষুনি হাল ছেড়ে বসে পড়লাম ধপাস করে ।
এখন আমি বুঝতে পারছিলাম আমার চুল বেয়ে টপ টপ করে ঘাম পড়ছে, তাই রুমাল দিয়ে ঘার মুছলাম। কিন্তু অল্পক্ষন পরেই বুঝলাম কোনো লাভ নেই; রুমাল ভিজে চপ চপ করছে, কিন্তু ঘাম কমবার কোনো লক্ষন নেই । আমার পাছাও ঘামছিল আর আমার পাজামা ভিজে মাদুরের সঙ্গে লেপ্টে গেছে ।
যুয়ান হঠাত বলে উঠল- আপনি ডাক্তার ?
হ্যাঁ
খুব কি কষ্ট হয়।। অনেক্ষন সময় লাগে ?
য়্যাঁ, কি, আরে নানা, একদমই নয় । খুব তাড়াতাড়ি সব শেষ হয়ে যায় – এমন ভাবে বলছিল যেন ব্যাঙ্কের গ্রাহক কে বোঝাচ্ছে ।
কিন্তু আমি, ওরা বলছিল, অনেক সময় দু-বার গুলি করতে হয় !
বেলজিয়ানটা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ মাঝে মাঝে প্রথমবার ঠিক জায়গা মতন লাগে না। তারা আবার বন্দুকে গুলি ভরে প্রথম থেকে শুরু করে তাক করতে। একটু ভেবে নিয়ে বলল “ এরকম হলে বেশ সমায় লাগে বৈকি ।
ছেলেটার বয়স কম তাই যন্ত্রনা পাবার ভীষণ ভায় পাচ্ছে । আমি কষ্ট পাবার কথা একেবারেই ভাবছিলাম, ব্যাথা পাবার ভয় আমার ছিল না, আমি অন্য কারনে ঘামছিলাম ।
আমি উঠে কয়লাগাদের দিকে হেঁটে গেলাম । আমার জুতোর ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজে বিরক্ত হয়ে টম একবার তাকাল আমার দিকে । টমের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আন্দাজ করার চেষ্টা করছিলাম যে আমার মুখটাও কি টমের মতন দেখাচ্ছে- সাদা মাটির মতন । টম ও আমার মতন দর দর করে ঘামছিল । আমি মাথা তুলে গর্তের মধ্যে দিয়ে আকাশ দেখার চেষ্টা করলাম । আকাশটা কি সুন্দর। মাথা তুললেই আমি এক টুকর আকাশ দেখতে পাচ্ছি , কিন্তু সেখান থেকে এক কনাও আলো এই অন্ধকার কোনায় এসে পৌঁছাচ্ছিলনা । কিন্তু কাল রাতেও আমি সেই ধর্মস্থানস্থিত কারাগৃহ থেকে বিশাল আকাশ দেখতাম, দিনের এক একটা সময় এক এক রকম স্মৃতি আমার মনে গেঁথে আছে । সকালের স্বচ্ছ নীল আকাশ দেখে আমার এটল্যান্টিক সমুদ্র সৈকতের কথা মনে পড়ত । দুপুরের আকাশ দেখে আমার সেভিলের এক সুঁড়িখানা খানার কথা মনে পড়ছিল, ঠিক এমনি এক দুপুরে সেখানে আমি মদ্যপান করেছিলাম সাথে সুস্বাদু চাট; দুপুর যখন গড়িয়ে যায় সেই সময় ছায়াতে বসে বসে সেই গোল চত্বর মনে করিয়ে দিত, যেখানে আমরা ষাঁড়্রর লড়াই দেখতাম, দিনের এমন সময়টা গোলাকৃত সেই ময়দানটার ঠিক অধের্কটা সুর্যের আলো এসে পড়ত বাকি অধের্কটা অন্ধকার। সত্যি সে ভারী এক বেদনাদায়ক অনুভুতি, এক আকাশ দেখে সাড়া পৃথিবীকে মনে করার চেষ্টা । এখনই বরঞ্চ ভাল আছি, যত খুশী আকাশ দেখিনা কেন, আমার মনকে আর কোনো পূর্বস্মৃতি ছুঁতে পারছেনা । হ্যাঁ এটাই ভাল । আমি ফিরে এসে টমের পাশে বসলাম । দীর্ধ সময় অতিবাহিত হল এক অদ্ভুত নৈঃশ্বব্দতার মাঝে ।
অবশেষে টম খুব নীচু স্বরে কথা বলতে সুরু করল । কথা না বলে থাকতে পারবেনা টম, না হলে নিজেকেই নিজে চিনতে পারবেনা । প্রথমে আমি ভেবেছিলাম টম আমার সঙ্গে কথা বলছে, কিন্তু দেখলাম আমার দিকে তাকাচ্ছেনা । আসলে আমার দিকে তাকাতে সাহস হচ্ছেনা । আমাকে দেখলে ও তো নিজেকেই দেখতে পাবে। আমরা একে অপরের আয়না যেন, ভীত, ত্রস্থ, ঘর্মাক্ত এবং ছাইএর মতন ফেকাসে । তাই সে জীবিত মানুষের দিকে তাকিয়ে ছিল, সেই বেলজিয়ান ডাক্তারের দিকে ।
তুমি কিছু বুঝতে পারছ? আমি তো পারছিনা ।
বেলজিয়ানটার দিয়ে তাকিয়ে আমিও টমের মতন নীচু স্বরে বললাম – কেন কি হয়েছে ?
আমাদের জীবনে এমন একটা কিছু ঘটতে চলেছে, কিন্তু সেটা ঠিক যে কি আমি বুঝতে পারছিনা।
টমের গা থেকে একটা অদ্ভুত গন্ধ আসছিল । গন্ধের ব্যাপারে আমি অনেকের থেকে অনেক বেশী সচেতন । একটু হেসে বললাম – এখনি বুঝতে পারবে ।
এটা পরিস্কার হয়ে গেছে আমার কাছে , ভীষণ জেদের সংগে বলে উঠল , আমি সাহসের সঙ্গে অবস্থার মোকাবিলা করতে চাই, কিন্তু আমাকে তো জানতে হবে কি হতে চলেছে । শোন, ওরা আমাদের চাতালে নিয়ে যাবে, ভাল কথা । তারপর তারা আমাদের সামনে সারি বেঁধে দাঁড়াবে । জান কি ওরা কতজন থাকবে ?
আমি ঠিক জানিনা । পাঁচ থেকে আট জন হবে আর কি। এর থেকে বেশী নয় ।
বেশ। ওরা আটজন আমাদের দিকে বন্দুক তাক করবে । তারপরে কেউ একজন বলবে “ফায়ার “ ওমনি আমি দেখবে আটটা বন্দুক আমার দিকে ফেরান । আমার মনে হবে যেন পিছনের প্রাচীর ভেংগে তার মধ্যে সেঁদিয়া যাই । আমার সর্ব্ব শক্তি দিয়ে আমার পিছনের প্রাচীর ঠেলতে থাকব , কিন্তু একটা মুর্তিমান দুঃস্বপ্নের মতন দেয়ালটা অচল দাঁড়িয়ে থাকবে তার জায়গায় । আমি সব কল্পনা করতে পারছি । তুমি যদি জানতে আমি কত নিখুত ভাবে সব কল্পনা করতে পারি !
ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমিও কল্পনা করতে পারছি ।
নিশ্চয় ভযানক যন্ত্রনা হবে । তুমি জাননা বোধ হয় ওরা প্রথমে আমাদের চোখ, মুখ তাক করে গুলি চালাবে, আমাদের শরীর বিকৃত করবার জন্য । প্রচন্ড ঘৃণা সহকারে কথাটা বলল । আমি এখনি যন্ত্রনা অনুভব করতে পারছি । গত এক ঘন্টা ধরে আমি আমার মাথায়, ঘারে যন্ত্রনা ওনুভব করছি । আসল যন্ত্রনা নয় তার থেকেও কনেক খারাপ । কাল আমি এরকম যন্ত্রনা পাব- তারপর, তারপর কি হবে ?
আমি খুব ভাল করেই বুঝতে পারছিলাম ও কি বলতে চাইছে । কিন্তু আমার বুঝতে ইচ্ছা করছিল না । গত এক ঘন্টা ধরে আমিও সারা দেহে অগুন্তি ক্ষতের যন্ত্রনা অনুভব করছিলাম । কিন্তু টমের মতনই আমি সেই যন্ত্রনা বোধের জন্যে বিচলিত হচ্ছিলাম না একটুও । আমি বললাম – তারপর তুমি চোখে সরষেফুল দেখবে ।
বেলজিয়ান ডাক্তারের ওপর থেকে চোখ না সরিয়েই আবার নিজের মনে বক বক শুরু করল টম। বেলজিয়ানটা আমাদের কথায় কান দিচ্ছিল বলে মনে হচ্ছিল না। আমি জানি, আমরা কি ভাবছি তাই নিয়ে বেটার কিচ্ছু যায় আসেনা। ও আসলে এখানে এসেছে মজা দেখতে, দেখতে কি করে তিনটে তাজা প্রাণ মৃত্যুর আগেই কেমন ভাবে তিল তিল করে শেষ হয়ে যাচ্ছে ।
টম বলছিল এটা একটা দূঃস্বপ্নের মতন মনে হচ্ছে । আমি বোঝবার চেষ্টা করছি, মনে হচ্ছে যেন একটা ধারনা হচ্চে , ধীরে ধীরে পরিস্কার হচ্ছে ব্যাপারটা , কিন্তু হঠাতই দেখছি আমি যে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই আছি, আবছা মতন যে ছবিটা চোখের সামনে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছিল সেটা কোথাও মিলিয়ে গেছে । আমি আমার ্মন কে বোঝাচ্চি যে মৃত্যুর পরে কিছু থাকবেনা, কোনো অস্তিত্বই থাকবেনা- কিন্তু আমি ঠি মতন অনুধাবন করতে পারছিনা, সেই অবস্থাটা, যেখানে কিছু নেই, আমি নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় যেন একটু একটু ধারনা করতে পারছি, আবার যেমন তোমাকে বললাম সব কিছু কেমন গুলিয়ে যায়, আর সেই পুরোনো ব্যাথার আর যন্ত্রনার, সেই গোলা গুলির উপলব্ধি ফিরে আসে । আমি একজন প্রখর বাস্তব বাদী, মাইরি বলছি, আমি পাগল হয়ে যাচ্চিনা । আমি আমার মৃত দেহ মানস চোখে দেখতে পাচ্চি , সেটা এমন কিছু শক্ত ব্যাপার নয়, কিন্তু আমি নিজের চোখে আমার মৃত শরীর পরে থাকতে দেখছি, ভাব!
আমার ভাবতে হবে যে আমি আর নেই, আমি আর কিছু দেখতে বা শুনতে পাচ্ছিনা, কিন্তু আর সবই ঠিক আগের মতন থাকবে, জগত তার নিজের মতন চলবে, আমার চেনা , অচেনা সবাই বেঁচে থাকবে, দেখবে , শুনবে । কিন্তু, প্যাবলো, তুমি মানোতো যে আমরা এরকম ভাবে চিন্তা করতে অভ্যস্ত নই , এটা আমাদের জন্যে স্বাভাবিক চিন্তা নয়। আমি ইতি মধ্যেই সারারাত জেগে একটা কিছুর জন্যে অপেক্ষা করছি, কিন্তু এমন একটা কিছুর জন্যে নয়, যেটা চুপি চুপি, ধীরে ধীরে, পিছন থেকে এসে আমাদের গ্রাস করবে ।। প্যাবলো আমরা এককম একটা কিছুর জন্যে কেমন করে প্রস্তুত হব বলতো ।
“উফ, তোমার মুখ বন্ধ করবে নাকি পুরোহিত ডাকবো “
অনেক্ষন ধরে লক্ষ করছিলাম টম একটা ভাবলেশহীন মুখ করে েএকটানা বকে ছলেছে, যেন সে এক ভবিষ্যত দর্ষা, আর আমাকে প্যাবল বলে সম্মোধন করছে । আমার একটুও ভাল লাগছিলনা, কিন্তু কি আর করা আইরিশ রা সব একই ধরনের হয় দেখছি । আমার কিরকম যেন মনে হচ্ছিল যে টমের গা থেকে পেচ্ছাপের গন্ধ আসছিল । কার্যত টমের জন্য কোন বিশেষ সহানুভুতি আমার ছিল না, কেনই বা থাকবে, আমরা দুজনেই তো একই পথের যাত্রী, এক সঙ্গে মরতে চলেছি । অন্য কেউ , যেমন ধরা যাক রোমান গ্রুস, যদি আমার সঙ্গী হত তাহলে ব্যাপারটা অন্য রকম হত । কিন্তু যুয়ান আর টমের সঙ্গে আমি কোনো রকম সহমর্মিতা অনুভব করছিলুম না । নিজেকে দু-জনের মাঝখানে খুব একা লাগছিল- কিন্তু এই বেশ, এই ভাল । যদি এখানে আমার সঙ্গে রামন গ্রিস থাকত, তাহলে আমি অনেক বেশি বিচলিত হতাম, অনেক বেশি যন্ত্রনা অনুভব করতাম । আমি এখন খুব বেশি কঠিন নির্দয় অবস্থায় আছি , আর এককম ই থাকতে চাই আমি ।
আমি বুঝতে পারছিলাম, টম নিজেকে ব্যাস্ত রাখার জন্য ক্রমাগত কথার জাবর কাটছিল, যেন ওবধারিত মৃত্যুর চিন্তা তার মনে না স্থান পায় । ওর গায়ের থেকে বিচ্ছিরী রকমের পেচ্ছাপের গন্ধ আসছিল, সাধারনত প্রস্টেট গ্ল্যান্ড দুষ্ট রোগীদের কাছ থেকে পাওয়া যায় । আমি ওর সঙ্গে সম্পুর্ন এক মত, আমাদের মৃত্যু মোটেই স্বাভাবিক নয় । এবং যেহেতু আমি মরতে চলেছি , আমার কাছে কিছুই স্বাভাবিক লাগছিলনা, ঘরের কোনায় রাখা কয়লার গুঁড়, সামনের বেঞ্চিটা, বা পেড্রোর কুৎসিত মুখ । কিন্তু এই যে সারারাত ধরে আমি আর টম একই রকম চিন্তা করছি, একই ভাবে, সেটা আমায় কুরে কুরে খাচ্ছিল। আমি আড় চোখে টমের দিকে তাকালাম, ওকে কেমন যেন অন্যরকম লাগছিল, মনে হচ্ছিল ওর মুখের প্রতিটি রেখায়, প্রতিটি কম্পনে আসন্ন মৃত্যুর কথা লেখা আছে । আমার অহঙ্কার, আমার আত্মস্নমান, তলানি তে গিয়ে ঠেকেছে । গত চব্বিশ ঘন্টা আমি ওর পাশে বসে কাটিয়েছি, ওর প্রতিটি আক্ষেপ শুনেছি, ওর সঙ্গে কথা বলেছি আর আমি খুব ভালই বুঝতে পারছিলাম আমাদের মধ্যে কোনো মিল নেই । কিন্তু এখন ওর দিয়ে তাকিয়ে আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম যে আমাদের মধ্যে এখন এমন একটা আশ্চর্য মিল দেখা যাচ্ছে, যাতে করে যে কেউ আমাদের যমজ ভাই বলে ভাবতে পারে, কারন আমরা দু-জনে একই সাথে মরতে চলেছি, আর আমাদের দু-জনের চোখে মুখে সেই কথা স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে ।
আমার হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে, আমার দিকে না তাকিয়ে বলল টম- “প্যাবলো, আমি ভাবছি, এটা কি সত্যি যে সব কিছু শেষ হতে চলেছে,
ঝট করে আমার হাত্ সরিয়ে নিয়ে আমি বললাম- শালা শুয়ার নিজের দু-পায়ের ফাঁকে তাকিয়ে দেখ আগে ।
টমের দু-পায়ের নিচে জল, আর ওর পাজামার তলা থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছিল ।
বিস্ফারিত চোখে টম বলে উঠল- এটা কি ?
তুমি পাজামায় পেচ্ছাপ করেছ ।
নানা কক্ষোন নয় । এটা আমি করিনি ।আমি তো কিছু বুঝতেই পারিনি- চেঁচিয়া উঠল টম ।
বেলজিয়ানটা দূর থেকে আমাদের লক্ষ করছিল, এখন এগিয়ে এসে সমবেদনার ভান করল – তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে ?
টম চুপ করেছিল । বেলজিয়ানটা জলের দিকে তাকিয়ে কিছু বলল না ।
ভীষণ হিংস্রভাবে টম বলল – আমি জানিনা এটা কি । কিন্তু আমি একটুও ভয় পাইনি। মাইরি বলছি আমি ভয় পাচ্ছিনা ।
বেলজিয়ানটা এ কথার কোনো উত্তর করলনা । টম উঠে কোনায় গেল নিজেকে হাল্কা করতে ।পাজামার বোতাম লাগাতে লাগাতে ফিরে এল আবার আর নিরুত্তরে নিজের জায়গায় বসে পড়ল । বেলজিয়ানটা খাতায় লিখছিল ।
আমরা তিনজনেই তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, কারন সেই একমাত্র ্সত্যিকারের জীবিত ব্যাক্তি আমাদের মধ্যে । এই লোকটার হাঁটা-চলা, কথা বলা সব কিছুর মধ্যেই একজন জীবিত প্রাণী কে দেখতে পাচ্ছিলাম । ও একজন সুস্থচ স্বাভাবিক লোকের মতনই ঐ ঠান্ডা কনকনে ঘুপচির মধ্যে শীতে কাঁপছিল, ওর শরীর ওর নিজের বশে । বাকী আমরা কজন আমাদের শরীরকে অনুভব ই করতে পারছিলাম না, অন্তত লোকটার মতন করে তো নয়ই । আমার মনে একটা ইচ্ছে মাঝে মাঝেই দানা বাঁদছিল, যে দুপায়ের ফাঁকে আমার পাজামাটা স্পর্শ করি, কিন্তু সাহস হচ্ছিল না । আমি বেলজিয়ামটাকে দেখছিলাম কেমন নিজের শরীর নিজেই চালনা করছিল, কেমন সুদৃঢ় পদক্ষেপে নিজের শরীর কে বহন করছিল, একজন স্বাভাবিক লোক যে কালকের কথা নির্দ্বিধায় চিন্তা করতে পারে । আমরা যেন তিন নীরক্ত ছায়া শরীর, জীবিত লোকটার দিকে তাকিয়ে লুব্ধ অভুক্ত রক্ত চোষা বাদুরের মতন ওর জীবন বিন্দু বিন্দু পান করছিলাম ।
অবশেষে লোকটা ছোট্ট যুয়ানের কাছে গেল । এখন ও কি কোনো এক ডাক্তারি ঙ্গান চরিতার্থ করতে গেছে, নাকি নেহাত ই দয়াপরবস হয়ে। যদি তাই হয়, তাহলে বলতেই হবে আজ রাতে এই প্রথমই সে কোনোরকম মানবিক আচরন করছে ।
ছেলেটার মাথায়, ঘারে সস্নেহে হাত বোলাতে লাগল। ছেলেটা প্রথমটা একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে ছিল , তারপর হঠাত তার হাতটা টেনে নিয়ে অদ্ভুত ভাবে দেখতে থাকল। বেলজিয়ানের হাতটা তার দুহাতের মধ্যে ধরা ছিল, মনে হচ্ছিল যেন দুটো ছাই রঙ শাঁড়াষির মাঝখানে ধরা একটা গোলগাল বাদামী পুরুষ্টু হাত । আমি যা সন্দেহ করছিলাম তাই হল, টমও মনে হয় এই ভায়টাই পাচ্ছিল, কিন্তু বেলজিয়ানটা কিছুই আন্দাজ করতে পারেনি তাই বেশ একটা সস্নেহ হাসি নিয়ে ছেলেটার কার্যকলাপ দেখছিল । তাকে চমকে দিয়ে যুয়ান তার হাতটা মুখের কাছে এনে কামড়ে দেবার চেষ্টা করল । ছিটকে সরে গিয়ে পিছনে দেওয়ালে ধাক্কা খেল লোকটা। এক মুহুর্তের জন্য আমাদের তিনজন কে সভয়ে দেখে নিল সে । এতক্ষনে সহসাই এটা তার মাথায় ঢুকল যে আমরা ওর নিজের মতন স্বাভাবিক মানসিক অবস্থায় নেই । আমি প্রচন্ড জোরে হাসতে সুরু করতে একজন রক্ষি লাফিয়ে উঠল, আর একজন ঘুমাচ্ছিল তার সদ্য ঘুম ভাঙ্গা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল ।
আমি একই সঙ্গে অনেকটা হাল্কা আর বেশ চঞ্চল বোধ করছিলাম । আমি আর কাল ভোরের কথা বা আসন্ন মৃত্যুর কথা ভাবতে চাইছিলাম না । কোনো মানে হয়না । শুধু কতগুল শব্দ, যা কোনোই অর্থ বহন করে না । কিন্তু যতবারই আমি অন্য কিছু ভাববার চেষ্টা করছিলাম, আমি আমারদিকে তাক করা বন্দুকের নল দেখতে পাচ্ছিলাম । আমি এক রাতের মধ্যে অন্তত কুড়িবার আমার মৃত্যুকে অনুভব করেছি, একবার তো আমি ভেবেছিলাম ঘটনাটা বাস্তবেই ঘটছে, কল্পনা নয়, মানে আমি বোধ হয় একটু সময়ের জন্যে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। মনে হল ওরা আমাদে হির হির করে টেনে নিয়ে দেওয়ালের গায়ে দাঁড় করিয়ে দিল, আমি নিজেকে ছাড়াবার প্রানপন চেষ্টা করছিলাম, আমাকে প্রানদান করার জন্য সকাতরে অনুনয় করছিলাম ‘ এমন সময় চমকে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল । দেখলম বেলজিয়ানটা আমার দিকে তাকিয়ে। আমি কি কোনো রকম শব্দ করেছি ঘুমের মধ্যে। না লোকটা কিছু খেয়াল করেনি নিজের মনে গোঁফ পাকাচ্ছে দেখলাম । চেষ্টা করলে আর একটু ঘুমাতে পারতাম । পুরো আটচল্লিশ ঘন্টা ঘুমায়নি । প্রবল ভাবে পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত ।
কিন্তু জীবনের শেষ দু-ঘন্টা আমি গুমিয়ে নষ্ট করতে চাই না; ওরা যখন আমকে ভোর বেলায় ডাকতে আসবে তখন আমি প্রায় অচেতন অবস্থায় মৃত্যুর মোকাবিলা করব, হয়ত একবার উঃফ বলার অব্দি সুযোগ পাবনা । আমি তা চাইনা । আমি একটা জন্তুর মতন মরতে চাইনা, আমি আমার মৃত্যু কে জানতে চাই, বুঝতে চাই। তাছাড়া এখন ঘুমালে আবার এরকম দুঃস্বপ্ন দেখতে পারি, এ ভয় ও ছিল । আমি উঠে পায়চারি করতে লাগলাম । নিজের চিন্তাটাকে ফেরাবার জন্য আমার অতীত জীবনের কথা মনে করার চেষ্টা করছিলাম । একরাশ স্মৃতি হুড় হুড় করে সামনে এসে দাঁড়াল । কিছু সুখের, কিছু দুঃখের স্মৃতি, অন্তত একসময় এরকমই ভাবতাম আমি । কিছু মুখ, কিছু ঘটনা আমার চোখের সামনে দ্রুত ভেসে উঠছিল, যেমন সেই অল্প বয়সী বুল-ফাইটার যাকে রক্তাক্ত হতে দেখেছিলাম, আমার এক প্রিয়া কাকার মুখ, রামন গ্রাসের মুছ। আমার বিগত জীবনের কথা বিচ্ছিন্ন ভাবে মনে পড়ছিল ।আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল ১৯২৬ সালে পুরো তিনটে মাস আমার কোনো কাজ ছিল না । টাকার অভাবে আমার খাওয়া জুটতনা । একবার পর পর তিন দিন আমি অভুক্ত অবস্থার রাস্তার বেঞ্চে শুয়ে কাটিয়েছি । আমি মৃত্যুর সংগে যুদ্ধ করেছি, কারন আমি মরতে চাইনি, নিজের দুর্দশায় কি পরিমান ক্রুদ্ধ ছিলাম, ভেবে আমার এখন হাসি পাচ্ছে । আমি কি পাগলের মতন সুন্দরীদের পিছনে, অর্থের জন্য আর মুক্তির জন্য দৌড়ে বেড়িয়েছি। কারন আমি তখন আমার দেশ স্পেন কে মুক্ত করার স্বপ্ন দেখছিলাম । আমি নেতা মারগালের মুগ্ধ ভক্ত ছিলাম আর তার বিপ্লবী য়ান্দোলোনে যোগ দিয়েছিলাম । তখন আমি জনসভায় ভাষণ দিচ্ছি । আমি এমনভাবে সব কিছুর সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে রেখেছিলাম যেন আমি অমর, চিরকাল থাকব ।
সে সময় আমি ভাবতাম আমার সমনে আমার সারা জীবন পরে আছে। এখন আমি বুঝেছি এটা কতবর মিথ্যা, অর্থহীন ভাবনা । এ জীবনের কোনো অর্থ নেই, কারন এটা শেষ হয়ে যাবে । এক সময় আমি কত নারী সঙ্গ করেছি, তাদের সঙ্গে হেঁটেছি, গল্প করেছি , কত মুল্যবান সময় কাটিয়েছি । তখন যদি জানতামি আমার এই পরিণতি হবে তাহলে আমি আমার কড়ে আঙ্গুল ও নাড়াবার শক্তি পেতাম না । আমার জীবনের দরজায় তালাচাবী পড়ে গেছে, অথচ তার ভিতরে সবই অসমাপ্ত, সব কাজ, সব ইচ্ছা, সব আশা অপূর্ণ রয়ে গেছে । এক মুহুর্তের জন্য আমার মনে হল জীবন কি সুন্দর। কিন্তু আমি সে ভাবে কিছুই বলতে পারবনা জীবন সম্মন্ধে , কারন জীবন নামক বস্তুটা অজানা অধরা থেকে গেছে, যেন একটা আবছা পেনসিলে আঁকা ছবি, তার মধ্য কিছুই বিশেষ ভাবে মূর্ত নয়, আমি এই আদি-অন্তহীন কালের একটি কনা মাত্র বেঁচেছি, তাকে কিছুই বুঝিনি, সে আমার বোঝার বাইরে । আমি আর কিছুর ই অভাব বোধ করছিনা । কত কিছুই আমার চাইবার ছিল, দেখবার ছিল, জানবার ছিল, কিন্তু আসন্ন মৃত্যু আমার মধ্যে আর কোনো আকাঙ্খা অবশিষ্ঠ রাখেনি ।
হঠাত করে বেলজিয়ানের মাথায় একটা নতুন বুদ্ধি এল- সে বলল যদি সেনা আদালত অনুমতি দেয় তাহলে আমি তোমাদের প্রিয়জনের জন্য তোমাদের শেষ বার্তা বা উপহার পৌঁছে দিতে পারি ।
টম বির বির করে বলল “আমার কেউ নেই”
আমি চুপ করে আছি দেখে আমার দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি দিয়ে টম জিগ্যাসা করল – কঞ্চা কে কিছু বলার নেই তোমার ?”
“না”
আমার নিজের ওপর খুব রাগ হচ্ছিল , কেন যে কাল রাতে কঞ্চার কথা টমকে বলতে গেলাম । আমি একবছর কঞ্চার সঙ্গে থেকেছি । কাল আমার এত মন খারাপ লাগছিল যে আমি কঞ্চাকে আর একবার দেখবার জন্য আমার ডান হাতটা পর্যন্ত বিসর্যন দিতে পারতাম । কিন্তু আজ আমার মধ্যে কঞ্চার জন্য কোনো রকম আকর্ষন অবশিষ্ট নেই । আজ যদি আমার সামনে এসে দাঁড়ায় ওকে বুকে টেনে নেবার কোন রকম ইচ্ছাই আমার হবে না । আমার নিজের ঘর্মাক্ত নোংরা শরীরটা কে আমার ঘৃণা হচ্ছে, এমনকি কঞ্চার শরীরটাও যে আমাকে বিব্রত করবে না সে বিষয়েও আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম না । আমার মৃত্যুর কথা জানতে পারলে কঞ্চা খুব কাঁদবে, অনেক দিন পর্যন্ত তার জীবনের প্রতি সব আকর্ষন চলে যাবে , আমি জানি । তবুও শেষ কথা হল, সে জীবিত থাকবে আর আমার সামনে নিশ্চিত মৃত্যু । কঞ্চার নরম , সুন্দর দুটি চোখের কথা আমার মনে পড়ে গেল । ঐ চোখে যখন আমার দিকে তাকাত সেই দৃষ্টি আমার অস্তিত্ব ছুয়ে যেত । কিন্তু আমি জানি সে সব কিছু শেষ হয়ে গেছে । কঞ্চার দৃষ্টি আর আমাকে ছুঁতে পারবে না, আমি একা, সম্পুর্ণ একা ।
টমও একা তবে আমার সঙ্গে একটু পার্থক্ব আছে । কাঁচি-পায়ে বসে টম কেমন একটা অদ্ভুত হাসি হাসি মুখে সমনের বেঞ্চিটার দিকে তাকিয়ে ছিল । খুব সাবধানে আলতো করে হাত রাখল বেঞ্চিটার ওপর যেন কিছু ভেঙ্গে যেতে পারে, তার পরেই কেঁপে উঠে হাত সরিয়ে নিল। আমি হলে এরকম করতাম না । আইরিশ লোকেরা কেমন যেন । আজ এখানে সব কিছুই আমার কাছেও নতুন এবং অন্য রকম প্রতিভাত হচ্ছিল , সব কিছুই যেন ভঙ্গুর তাদের ঘনত্বও আমার চোখে কম বলে মনে হচ্ছিল বেঞ্চি , লম্ফ, কয়লার গাদা সব কিছু যেন আমার থেকে তাদের দুরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছে । আমি তো মরে যাব আর এরা যেন মৃত্যুপথযাত্রীর রোগীর শয্যার পাশে বসে নিজেদের মধ্যে ফিস ফিস করে কথা বলছে । টম বেঞ্চিতে হাত দিয়ে অদূরবর্তী সময় সেখানে নিজের অভাবটাই অনুভব করেছে ।
এখন যদি কেউ এসে আমাকে বলে যে আমাকে তারা বাড়ি ফিরে যাবার অনুমতি দেবে, আমার জীবন পুরপুরি ফিরিয়ে দেবে, তবুও আমি কনামাত্র উদবুদ্ধ হব না। মৃত্যু অবশম্ভাবী জেনে, আরো কিছূ ঘন্টা বা কিছু বছর বেশী বেঁচে থাকাটা আমাকে বেশী সোয়াস্ত্বি দিতে পারবেনা । আমি এই নশ্বরতাকে আঁকড়ে ধরে বসে ছিলআম, আর তাতে একধরনের শান্তি ও অনুভাব করছিলাম । কিন্তু এ শান্তি সুখকর নয়, কারন আমার শরীর, আমি এই শরীর দিয়ে দেখছি, শুনছি, কিন্তু শরীরটা তে আমি আর একাত্ম বোধ করতে পারছিলাম না । আমার শরীর কাঁপছে, ঘামছে, কিন্তু আমি সেটা বুঝতে পারছিনা, শরীর আমার বশে নেই, শরীরের বিভিন্ন জাগায় হাত দিয়ে অনুভাব করে বুধতে হচ্ছে সেখানে কি হচ্ছে, যেন অন্য কারো শরীর। কিছু সময় অবশ্য শরীরের উপস্থিতি টের পাচ্ছিলাম, যেমন মাঝে মাঝে ডুবন্ত মানুষের অনুভুতি টের পাচ্ছিলাম, যখন একটা ঊড়োজাহাজের যাত্রীরা অনুভাব করে, যখন সেটা হঠাত মাথা নিচু করে ঝাঁ করে নিচে নামে, বা আমার হৃদস্পন্দন । কিন্তু এতে আমার কিছু সুবিধা হচ্ছিলনা। কারন সময় সময় আমার শরীর আমাকে দুঃসংবাদ পাঠাচ্ছিল । যখন শরীর চুপচাপ থাকছিল তখন আমার শরীর কে কেবল একটা ভার বলে টের পাচ্ছিলাম । আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন এক অতিকায় ঘৃণ্য পোকার সঙ্গে বাঁধা রয়েছি । একবার আমার পাজামায় হাত দিয়ে দেখলাম সেটা ভেজা ভেজা; যদিও বুঝিনি সেটা ঘাম না পেচ্ছাপ তবু সাবধানতার খাতিরে কয়লার গাদায় নিজেকে হাল্কা করতে গেলাম ।
বেলজিয়ান তার ঘড়ি হাতে নিয়ে দেখে বলল- একন সারে তিন্টে বাজে ।
শুয়োরের বাচ্চা , ইচ্ছা করে বলল । টম লাফিয়ে উঠল ; খেয়াল করেনি যে সময় শেষ হতে চলেছে । রাত্রিটা েএতক্ষন আমাদের কাছে একটা আকার অবয়বহীন ঘন অন্ধকার প্রতিভাত হচ্ছিল । কখন যে শুরু হয়েছিল সেটাও মনে করতে পারছিনা ।
ছোটো ছেলে যুয়ান কাঁদতে শুরু করল। দু হাত রগরাতে রগরাতে অনুনয় করতে লাগল – আমি মরতে চাইনা, আমি মরতে চাইনা । সারা ঘরময় দু-হাত মাথার উপর করে দৌরে বেড়াল তার পর দড়াম করে একটা মাদুরে শুয়ে ভীষণ কান্নাকাটি জুরে দিল । টম দুঃখী দুঃখী চোখে দেখছিল, কিন্তু সান্ত্বনা দেবার কোনো চেষ্টা করলা না। কারন সেটা বৃথা , ছেলেটা এত চেঁচা মিচি, কান্নাকাটি করছিল কিন্তু ঠিক ততটা গভীর উপলব্ধি হয়নি । কোনো রোগীর জ্বর হলে যেমন তাকে অনেক সহজে রোগী যুঝতে পারে, যে রোগের কোনো বহিঃপ্রকাশ নেই সে রোগ অনেক বেশি মারাত্মক হয়ে ।
ছেলেটা কেঁদে চলেছে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম নিজের দুঃখে চোখের জল ফেলছে, এখনো মৃত্যুর স্বরূপ ও বুঝে উঠতে পারেনি । এক মুহুর্তের জন্য, খুব সামান্য এক সেকেন্ডের জন্য আমিও নিজের দুঃখে চোখের জল ভাসবার উপক্রম করেছিলাম । কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ঠিক তার বীপরিতটাই হল । দেখলাম কি বিশ্রীভাবে ছেলেটার সারা শরীর তার কান্নার তালে তালে দুলে দুলে উঠছে । আমার অমানুষিক ঘৃণার উদ্রেক হল । আমি করুনা ঘৃণা করি, অপরের প্রতি বা নিজের প্রতি কোনো ভাবেই আমি করুনা করা পছন্দ করিনা । আমি নিজেকে বোঝালাম – আমি পরিস্কার ভাবে মরতে চাই ।
টম উঠে ছেঝের গোল গর্তের নীচে দাঁড়িয়ে দিনের আলোর অপেক্ষায় তাকিয়ে রইল ।আমি মনকে কঠিন করে নিয়েছিলাম যে আমার মৃত্যু সহজ, সরল, পরিস্কার হবে , আমি আর কোনো কথা ভাবছিলাম না । কিন্তু যে মুহুর্তে বেলজিয়ান্টা সময়টা বলেছিল – আমার মনে হচ্ছিল সময় যেন উড়ে চলেছে, বিন্দু বিন্দু করে শেষ হয়ে আচ্ছে ।
বেশ অন্ধকারের মধ্যেই আমি শুনলাম টম বলছে- শুনতে পাচ্ছ পায়ের আওয়াজ ।
হ্যাঁ।
বাইরে সৈন্য মার্চ করার শব্দ আসছিল ।
কি করছে ওরা এখন । অন্ধকারে কি করে গুলি করবে ?
কিছুক্ষন পর বাইরে শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। আমি টম কে বললাম- সকাল হয়ে গেছে ।
ঘরের মধ্যেটা ছায়া ছায়া লাগছিল ।
বাইরে তখন গুলির আওয়াজ শুরু হয়ে গেছে ।
টম কে বললাম- ওরা শুরু করে দিয়েছে । নিশ্চয় পেছনের চাতালে আওয়োযন করেছে ।
টম ডাক্তারটার কাছে একটা সিগারেট চাইল । আমার এখন ধুমপান বা মদ্যপান কিছুই করতে ইচ্ছা করছেনা । তখন থেকে গুলির আওয়াজ আর বন্ধ হলনা ।
বুঝতে পারছ কি হচ্ছে বাইরে? টম জিগ্যাসা করল ।
আরো কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু চুপ করে গেল, কেননা দরজাটা বাইরে থেকে কেউ খুলছিল । একজন অফিসার , চারজন দলীয় কর্মী নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল , দেখে টম সিগারেটটা মাটিতে ফেলে দিল ।
শ্তেনবক?
টম উত্তর দিল না। পেড্র টমকে দেখিয়ে দিল ।
যুয়ান মিরবাল?
মাদূরের ওপর আছে ।
উঠে দাঁড়াও- অফিসার বলল।
যুয়ান নড়লনা দেখে দুজন কর্মী ওকে দুটো হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিল । কিন্তু হাত ছেড়ে দিতেই আবার ধপাস করে বসে পড়ল যুয়ান ।
ওরা দুজন ওর অবস্থা দেখে ইতস্তত করছে দেখে , অফিসার বলল –তোমরা কি প্রথম অসুশ্ত লোক দিখছ ! তোমরা ধরে নিয়ে যাও। বাইরে ওরা ঠিক ব্যাবস্থা করে নেবে । টমের দিকে ফিরে বলল “চল “
টমকে মাঝখানে নিয়ে দুজন কর্মী বেড়িয়ে গেল ।
বাকী দুজন যুয়ানকে পাঁজাকোলা করে ধরে নিয়ে গেল। যুয়ানের গ্যাঁন ছিল। ফ্যাল ফ্যাল করে তিকিয়ে ছিল, আর োর বড় বড় দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরছিল । আমি ও ওদের অনুসরন করতে উদ্যত হলাম – কিন্তু অফিসারটি আমাকে থামাল ।
তুমি ইব্বিয়েতা?
হ্যাঁ ।
তুমি এখানে অপেক্ষা কর তোমাকে ওরা একটু পরে নিয়ে যাবে ।
সবাই চলে গেছে। বেলজিয়ান ডাক্তার আর দু জন রক্ষীও নেই । আমি একেবারে একা বসে আছি। আমাকে নিয়ে কি করবে বুঝতে পারছিলাম। অদের সঙ্গে আমাকেও একবারে মেরে ফেললেই ভাল হত। বসে বসে অনবরত গুলির শব্দ শুঞ্ছিলাম আর প্রতিটি শব্দের সাথে সাথে সারা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছিল । আমার মনে হচ্ছিল চিতকার করি, আর দু-হাতে আমার চুল ছিঁড়ি ।
প্রায় এক ঘন্টা পরে ওরা এসে আমাকে দু-তলার একটা ঘরে নিয়ে গেল । ঘরটা বেছ ছোটো আর চুরুটের ধোঁইয়ায় আচ্ছন্ন । ঘরটা ভ্যাপসা গরমও । দুজন অফিসার চেয়ারে বসে চুরুট খাচ্চিল, তাদের হাঁটুর ওপর কিছু কাগজ পত্র ।
তুমি ইব্বেতিয়া
হ্যা
রামন গ্রস কথায় ?
আমি জানিনা ।
আমাকে যে প্রশ্ন করছিল লোক্টা বেশ বেঁটে আর মোটা। চশমার পিছন থেকে তার কঠিন চোখ আমাকে দেখছিল । এদিকে এস ।
গেলাম ।
উঠে দাঁড়িয়ে আমার হাতদুট নিজের হাতে নিয়ে আমার দিকে এমন একটা দৃষ্টি নিক্ষেপ করল , যেটা অন্য সময় হলে আমাকে মাটির সংগে মিশিয়ে দেতে সক্ষম হত । সর্বশক্তি প্রয়োগ করে আমার উপর হাতে সে চিমটি কাটল । আমাকে যন্ত্ররনা দেবার অভিপ্রায় নয়, এটা যেন একটা খেলা । ও আমাকে দাবাতে চাইছিল । এছাড়া দুর্বিত্তটা আমার মুখের ওপর তার পুতিগন্ধ ময় নিঃশ্বাস ত্যাগ করছিল । বেশ কিছুক্ষন আমরা ঐ ভাবে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিলাম, একে অপরে চোখের দিকে তাকিয়ে , আর আমার অসম্ভাব হাসি পেতে লাগল । যে লোকটা মরতে চলেছে তাকে কি অত সহজে দাবান যায় ? অগত্যা আমাকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে, নিজের চেয়ারে বসে পড়ল ।
রামনের জীবনের বিনিময়ে তোমার জীবন । যজি বল কোথায় লুকিয়ে আছে, তবে তোমার জীবন ফিরে পেতে পার ।
এই লোকগুলো দামী দামী পোষাক পরে এখানে বসে আছে, কিন্তু এরাও তো মরতে চলেছে । হয়ত আমার মৃত্যুর পরে, কিন্তু ওদেরও জীবন ক্ষনস্থায়ী । ওরা কাগজে নাম খুঁজছে, কাদের মারবে, কাদের বন্দী করবে । ওরা এই দেশের ভবিষ্যত, এখানকার নাগরিকদের ভবিষ্যতের মালিক মনে করছে নিজেদের । ওদের এই সব কার্য-কলাপ কি অকিঞ্চিতকর, কি হাস্যকর । আমার মনে হচ্ছিল এরা সব পাগলের দল ।
বেঁটে লোকটা এখনও আমার দিকে তাকিয়ে আছে । ওর প্রতিটা অঙ্গভঙ্গী দেখে মনে হয় সব মেকী, আমাকে দেখাবার জন্য যে সে কতটা হিংস্র জন্তু ।
তাহলে? বুঝতে পেরেছ ?
আমি জানিনা কোথায় আছে গ্রস । আমি যতদুর জানতাম ও এখন মাদ্রিদে আছে ।
অন্য লোকটা এবার তার হাতটা সামান্য নাড়াল । আমি ওদের সব চালই বুঝতে পারছিলাম আর স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছিলাম যে মানুষ এত নোংরা খেলাও খেলতে পারে ।
তোমাকে আমরা পনের মিনিট সময় দিলাম । চিবিয়ে চিবিয়ে বলল কথাটা । ওকে কাপড়কাচার ঘরে নিয়ে যাও । পনের মিনিট পরে নিয়ে আসবে। যদি তখনও না বলে তবে এখানেই ওকে গুলি করে মারা হবে ।
ওরা খুব ভাল করেই জানে ওরা কি করছে । একটা পুরো রাত আমি অপেক্ষা করেছি। তার পরেও আমাকে সেই ঘরে একা ফেরত পাঠাল একঘন্টা ধরে বসে থাকার জন্য, যখন আমি বুঝতে পারছিলাম টম আর যুয়ানকে ওরা বাইরে গুলি করে মারছে । আর এখন আমাকে এই কাপড়কাচার ঘরে বন্দি করে রেখেছি । ওরা এই খেলাটা রাত্রেঈ ঠিক করে রেখেছিল । নিশ্চয় নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে নিয়েছে যে এর থেকে বেশি স্নায়ুর চাপ সহ্য করা সহজ নয়, আর শেষ মেষ ওরা আমাকে পেড়ে ফেলবে ।
ওরা কিন্তু খুব ভুল করছে । ধোপাঘরে অত্যন্তে ক্লান্ত এবং শ্রান্ত আমি একটা টুলে বসে বসে চিন্তা করছিলাম । না না ভেবোনা আমি ওদের জঘন্য প্রস্তাব নিয়ে ভাবছিলাম । কারন আমি তো জানি গ্রস কোথায় আছে । শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে এক দূর সম্পর্কের ভাই এর বাড়িতে লুকিয়ে আছে গ্রস । আমি এ বিষয়েও নিশ্চিন্ত ছিলাম যে আমাকে যদিনা এরা অসহ্য স্বারীরিক নিগ্রহ না করে [ আমার মনে হচ্ছিল না যে এরা সেরকম কিছু করার কথা ভাবছে ], আমি কিছুতেই ওদের বলবনা গ্রস কোথায় লুকিয়ে আছে ।এ সবই ঠিক ঠাক করে নিয়েছি , কিন্তু আমি নিজেই বোঝবার চেষ্টা করছিলাম আমি কেন ঠিক এমনটা করবার বিষয়ে বদ্ধ পরিপক্ক । আমি মরে যাব তবু গ্রস কে ধরিয়ে দেব না । কিন্তু কেন? আমি রামন গ্রসকে তেমন কিছু ভাল বাসিনা। ওর প্রতি আমার ভালবাসা আজ ভোরেই নিঃশেষ হয়ে গেছে, যেমন শেষ হয়ে গেছে কঞ্চার প্রতি আমার প্রেম , আমার বেঁচে থাকার আগ্রহ । অবশ্যই গ্রস অনেক উচ্চ স্তরের মানুষ, প্রচন্ড শক্তি ধরে নিজের মধ্যে, এ সবই ঠিক, কিন্তু সে কারনে আমি আমার জীবন দিয়ে ওকে বাচাঁবার কথা স্থির করিনি । আমার কাছে আমার নিজের জীবনের মতন সব জীবনই সমান মূল্যহীন মনে হচ্ছে এখন । ওরা দেওয়ালের গায়ে দাঁড় করিয়ে বন্দুক চালাবে যতক্ষন না একটা জীবন শেষ হয়ে যায়, সেটা আমার জীবন না গ্রসের নাকি আর কারো, সেটাতে কোনো তারতম্য হবার কথা নয় । এটাও সত্যি যে রেমনের জীবন আমার থেকে , স্পেন এর জন্য বা এই আন্দোলোনের সাফল্যের জন্য অনেক বেশি মুল্যবান বা জরুরি – কিন্তু চুলোয় যাক স্পেন , চুলোয় যাক আন্দোলোন, আমার কাছে সব কিছুরই প্রয়োযন ফুরেয়ে গেছে কিন্তু তবু আমি এখানে বসে আছি, আমি মরে যাব তবু রেমন কে ধরিয়ে দেবনা ।
আমার নিজের কাছেই এই জিদ হাস্যকর লাগছিল । এই বোকার মতন একগূঁইয়ে পনা দেখে আমি নিজেই একটা বিকৃত আনন্দ পাচ্ছিলাম ।
ওরা এসে আমাকে আবার সেই দুজন অফিসারের কাছে নিয়ে গেল । আমার পায়ের ফাঁক দিয়ে একটা ইঁদুর ছুটে গেল দেখে আমার খুব মজা লাগল , আমি একজনের দিকে ফিরে বললাম –দেখলে ইঁদুরটাকে ?
লোকটা অত্যান্ত গম্ভীর ভাবে ছিল, কোনো উত্তর দিল না। আমার হাসি পাচ্ছিল, কিন্তু আমি নিজেকে সামলে রেখেছিলাম, কারন আমি নিশ্চিত একবার শুরু করলে আমি আর হাসি থামাতে পারবনা । লোকটার গোঁফ দেখে আমার মনে হল লোকটা শুধু শুধু চুল দিয়ে নিজের মুখ ভর্তি করছে, তাই বললাম –তোমার গোঁফ কামান উচিত । লোকটা আমাকে একটা মৃদু লাথি মারল । আমি চুপ করে গেলাম ।
তো, তুমি কি ভাবলে ? মোটা লোকটা জিগ্যাসা করল ।
আমি সকৌতুহলে লোকদুটোকে দেখছিলাম যেন খুব একটা অপরিচিত প্রজাতির পোকা দেখছি । মুখে বললাম- ও কবরখানায় লুকিয়ে আছে। কোনো সিন্দুকে বা কবরের মাটি খুঁড়ে যেখানে রাখা হয় সেই সব ঘরের মধ্যে ।
আমি মজা করছিলাম আর অপেক্ষা করছিলাম ওরা কখন উঠে দাড়িয়ে আমাকে গুলি করার আদেশ দেয় ।
লোকগুলো লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল । চল মোলেস, লেফটানেন্ট লোপেসের কাছে থেকে পনের জন সৈনিক নিয়ে নাও । আর তোমাকে বলছি শোনো- যদি সত্যি কথা বলে থাক তো তোমাকে ছেড়ে দেব। কিন্তু যদি দেখি আমাদের বাঁদরনাচ নাচাচ্ছ তবে তোমার কপালে দুঃখ আছে ।
বিরাট হৈ চৈ করতে করতে ওরা সবাই বেড়িয়ে গেল । আর আমি পরম প্রশান্তিতে দুজন রক্ষীর মাঝখানে বসে রইলাম । ওরা কি করছে ভেবে ভেবে আমি মনে মনে হাসছিলাম । আমার মনে হিংস্র আনন্দ হচ্ছিল । আমি মনে মনে কল্পনা করছিলাম ওরা একটা একটা করে কবর খুলে ভিতরে দেখছে, সিন্দুকের দরজা একটা একটা করে খুলছে , এবার মাটির ঘরগূলোর দরজ খুলছে । আমি অশরীরী আত্মা হয়ে ওদের এই নাজেহাল অবস্থা উপভোগ করছিলাম আর নিজেকে একটা নায়ক মনে হচ্ছিল । এক রক্ষীগুলো তাদের বড় বড় খুলন্ত গোঁফ নিয়ে আর ওদের ওপরওয়ালারা সেনা পোষাক পরে বাঁদর নাচ নাচছে । এটা ভীষন ভাবে আমাকে আনন্দ দিচ্ছিল ।
কিছুক্ষন পরে সেই বেঁটে লোক্টা একা ফিরে এল। আমি মনে করলাম আমাকে ক্ষতম করতে এসেছে, বাকীরা সব কবরখানায় আছে নিশ্চয় ।
অফিসারটা যখন আমার দিকে তাকাল ওকে মোটেই বোকা বোকা মনে হলনা । ওকে বাকীদের সঙ্গে বড় চাতালে নিয়ে যাও । গুলি চালনা শেষ হয়ে গেলে, একটা বিচার সভায় ঠিক হবে ওকে নিয়ে কি করা হবে ।
আমি কিছু বুঝতে না পেরে জিগ্যাসা করলাম- তার মানে ওরা আমাকে গুলি করবে না ?
আপাতত নয়। এর পরে কি হবে সেটা আমার ব্যাপার নয় ।
আমি তবু বুঝেতে পারছিলাম না- কিন্তু কেন ?
কিছু না বলে কাঁধ ঝাঁকাল। সৈন্যরা আমাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল । বড় চাতালে প্রায় শতাধদিক বন্দী দাঁড়িয়েছিল, তাদের মধ্যে অনেকেই মহিলা, শিশু এবং বৃদ্ধ । আমি ঘটনায় আকস্মিকতায় স্তম্ভিত হয়ে গেছিলাম । মাঝখানে গোলাকার ঘাস চত্বরে গিয়ে দাঁড়ালাম । দুপুরে আমাদের সৈন্য আবাসে খেতে দিল । দু-তিন জন আমার সঙ্গে কথা বলল ।আমি কোনো উত্তর দিতে পারছিলাম না । নিশ্চয় আমাকে চেনে । আমি কোথায় আছি তাই বুঝতে পারছিলাম না ।
সন্ধ্যের সময় ওরা দশ জন নতুন বন্দীকে ঠেলে দিল উঠনের মধ্যে । আমি গারচিয়াকে দেখে চিনতে পারলাম । আমি ভাবতেও পারিনি তোমাকে দেখতে পাব । খুব ভাগ্যবান বলতে হবে তোমাকে, বলল গারচিয়া ।
আমি বললাম – আমাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কেন বুঝতে পারছিনা, ওরা মত পরিবর্তন করেছে ।
গারসিয়া বলল- আমাকে আজ দুটোর সময় বন্দী করেছে ।
কিন্তু কেন? আমি অবাক হলাম গারসিয়া কখন কোনো রাজনৈতিক কার্যক্লাপের সঙ্গে যুক্ত ছিল না ।
জানিনা । যে কেউ ওদের মতে বিশ্বাসী নয় তাকেই বন্দী করছে । তারপর গলাটা নীচু করে বলল “ওরা আজ গ্রসকে ও ধরে ফেলেছে ।
আমার মাথা ঘুরে গেল – কখন ?
আজ সকালে । গ্রস বোকামি করেছে যে । ওর যে আত্মীয়ের বাড়ি থাকত তার সঙ্গে কি নাকি নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল, তাই তার বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিল । অনেক লোকই গ্রস কে আশ্রয় দিতে চেয়েছিল- কিন্তু কারো কাছে ঋনী থাকবেনা বলে বলেছিল আমি ইব্বিতার বাড়ি থাকব । তারপর যখন শুনল তোমাকেও ধরে নিয়ে এসেছে তখন গিয়ে কবরখানায় গিয়ে লুকিয়েছিল ।
কবরখানায়?
হ্যাঁ তো। কি বোকা বল, ঐ সব জায়গাতো এরা খুঁজবেই। ওরা ওখানে গেছিল আজ, আর গ্রস কে একটা কবরের মাটি রাখার ঘরের মধ্যে আবিস্কার করেছে । গ্রস ওদের দেখে গুলিও চালিয়েছিল, কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেনি । ওরা ধরে এনেছে ।
কবরখানায় ?
আমার চারপাশে সবকিছু যেন বাঁই বাঁই করে ঘুরছে আর আমি মাথা ঘুরে মাটিতে বসে পড়লাম। অট্ট হাসি হাসতে হাসতে একসময় আমার চোখ থেকে জল পরতে লাগল ।
An original translation of the story "The Wall" by Jean-Paul Sartre ]
প্রাচীর
আমাদের ঠেলা মেরে যে ঘরটায় ঢোকান হল সেটা বেশ বড় আর আলো ঝলমলে । অতো আলো আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিল । চোখ সয়ে আসাতে লক্ষ করলাম ঘরটার শেষ প্রান্তে একটা টেবিল এবং তার পিছনে চারজন লোক নাগরিক পোষাকে বসে কিছু কাগজ নাড়াচারা করছে ।দেখলাম এর আগেই আরো কিছু বন্দীর একটা দল সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে, আমরা ঘর পেড়িয়ে তাদের পাশে গিয়ে হাজির হলাম । দেখলাম এই দলটির কিছু বন্দী আমার পূর্বপরিচিত, কিছু একেবারে অচেনা এবং বিদেশী ।আমার সামনের সারিতে দু-জন গোল-মাথা, সাদা-চুল ওলা লোক ছিল তাদের এক-ই রকম দেখতে। মনে হল ওরা ফরাসী । ওদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বেঁটে লোকটা অনবরত তার পাজামার খুঁট ধরে টানাটানি করছিল- বুঝলাম, অপরিসীম স্নায়ু চাপে ভুগছে ।
প্রায় তিন ঘন্টা আমাদের চাটল লোকগুল আমার মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করছিল, যেন ঘিলুটিলু আর কিছু নেই, সব ফাঁকা । তবে ঘরের ভিতর বেশ গরম আর আরামদায়ক ।আগের চব্বিশ ঘন্টা আমরা শীতে হিহি করে কেঁপেছি শুধু । রক্ষীরা এক এক করে বন্দীদের টাবিলের সামনে দাঁড় করাচ্ছিল। সেই চারজন সকলের নাম আর পেশা জিঙ্গাসা করে ছেড়ে দিচ্ছিল; কিছু কিছু সময় দুটো-একটা প্রশ্ন করছিল , যেমন- আন্দোলোনের সাথে কি ভাবে যুক্ত ছিলে বা ৯ তারিখ সকালে কোথায় ছিলে, কি করছিলে ? ব্যাস ঐ পর্যন্ত- কারন এর উত্তর শোনার কোনো চেষ্টাও তারা করছিল বলে মনে হচ্ছিল না । কিছুক্ষন চুপচাপ শূণ্যে তাকিয়ে আবার কাগজে আমাদের ভাগ্য লিখতে শুরু করছিল । টমকে জিঙ্গাসা করল সে কি আন্তর্জাতীক- গেরিলা বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিল ? বেচারী টমের এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় ছিল না, কারন তার কাছ থেকে ইতিমধ্যেই এই সম্পর্কে কাগজ পত্র উদ্ধার হয়েছে । যুয়ান কে তারা কিছু জিঙ্গাসাই করল না, ওর নামটা শুনেই খাতায় অনেক কিছু লিখে ফেলল ।
যুয়ান বলল উঠল – আমার ভাই যোশুয়া ৮বিপ্লবী ছিল। কিন্তু ও আর এখানে নেই । আমি কোনো দলে নেই । আমি কোনো রাজনীতিও করিনা ।
লোকগুল তার কথার কোন উত্তর দিল না। যুয়ান আবার বলল “আমি তো কোন অন্যায় করিনি। আর একজন কি করছে তার জন্য আমি কেন শাস্তি পাব ? কথা বলতে বলতে যুয়ানের ঠোঁট কাঁপছিল । একজন রক্ষী তাকে টেনে সরিয়ে নিল ।
তোমার নাম প্যাবলো ঈব্বাইতা
হ্যাঁ
ওদের মধ্যে একজন আমার দিকে তাকাল –“ রামন গ্রস কোথায় ?”
আমি জানি না।
৬ তারিখ থেকে ১৯ তারিখ অব্দি তুমি তাকে তোমার বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিলে !
না ।
তারা কিছুক্ষন কাগজে কি সব লিখল; তারপর রক্ষীরা আমাকে বাইরে নিয়ে এল । বাইরে বারান্দায় যুয়ান আর টম দু-জন রক্ষীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। টম রক্ষীটাকে জিঙ্গাসা করল – “ কি হল এটা “
কিসের কি হলো ?
এটা কি জিঙ্গাসা-বাদ হোলো নাকি বিচার হয়ে গেল ?
বিচার – বলল রক্ষী ।
আমাদের নিয়ে কি করবে ওরা ?
রক্ষী বলল – তোমাদের জেলখানাতে ই শাস্তি শোনান হবে ।
আমাদের জেলখানাটা কার্যত একটা হাসপাতালের ঘর। এখন শৈত্যপ্রবাহ চলছে, তার জন্য ঘরটা অসম্ভব ঠান্ডা। আমরা সারা রাত ঠান্ডায় কাঁপলাম, দিনের বেলাতেও কোনো রেহাই পেলাম না শীত থেকে ।এর আগে পাঁচদিন আমি একটা মন্দির চত্বরে কাটিয়েছি-সেটা একটা বহু পুরাতন দেয়ালের গায়ে একটা ঘুপচি গর্ত বলতে যা বোঝায় কার্যত তাই। জেলখানা যত না তার থেকে অনেক বেশী বন্দী, তাই তারা আমাদের যেখানে পেরেছে ঢুকিয়ে রেখেছিল ।সে জায়গায় শীতে তেমন কষ্ট না পেলেও আমি একা একা হাঁপিয়ে উঠেছিলাম । এখানে অন্তত আমার সঙ্গী আছে ।যুয়ানের খুব-ই অল্প বয়েস আর অত্যন্ত ঘাবরে গেছে, তাই ওর কথা বলার মতন অবস্থা ছিল না। কিন্তু টম খুব কথা বলে আর ও স্পানিশ ভাষা বেশ ভালই জানে ।
ঘরটার মধ্যে একটা বেঞ্চি আর চারটে মাদুর পাতা ছিল । আমরা সেখানে নিঃশব্দে বিচারের অপেক্ষায় বসে রইলাম । একটা দীর্ঘ নীরবতার পরে টম বলল “আমাদের বাম্বু হয়ে গেল “
আমারও তাই মনে হচ্ছে, কিন্তু বাচ্চা ছেলেটাকে কিছু করবে না।
ওর বিরুদ্ধ্বে কিছু বলতে পারবেনা। ওর ভাই জংগী ছিল, ব্যাস ।
আমি যুয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, আমাদের কথা ওর কানে যাচ্ছে বলে মনে হলনা।
টম তখন কথা বলা থামায়নি। বলল “তুমি জানো ওরা সারাগসা তে কি করেছে? আমাকে সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা একজন মরক্কের লোক বলে ছিল, ওরা বন্দীদের রাস্তায় ফেলে তাদের ওপর দিয়ে ট্রাক চালিয়ে দিয়েছে। গুলি-গোলা বাঁচাবার জন্যেই করেছে শুনলাম ।“
কিন্তু এতে পেট্রল খরচ হছে তো। আমার ভীষন রাগ হছিল টমের ওপর; এখন কি এসব কথা বলার সমায় ।
ওদের লোকেরা রাস্তার ধারে ধারে দেখাশোনা করে আবার, আর আরামসে ধুমপান করে । ভেবনা যে একবারে মেরে ফেলে । ধীরে ধীরে কষ্ট দিয়ে মারে । যন্ত্রনায় ছট-ফট করে চিতকার করে ঘন্টার পর ঘন্টা আর ওরা মজা দেখে । লোকটা বলছিল, প্রথমবার ও বমি করে ফেলেছিল প্রায় ।
আমার মনে হয়না এখানে সেরকম কিছু করবে, যদিনা গুলিগোলা একদম শেষ হয়ে গিয়ে থাকে ।
ঘরটার ছাতে চারটে গোল গর্তমতন ছিল, যার ভেতর দিয়ে হাওয়া-বাতাস আসছিল, আকাশ ও দেখা যাচ্ছিল। গর্তগুলো বন্ধ করার জন্যে গোল গোল ঢাকনাও ছিল, কিন্তু মনে হয় লাগাতে ভুলে গেছে। এই গর্ত দিয়ে ঘরের ভিতর কয়লা ফেলে মনে হত আগে, আগুন জ্বালে ঘর গরম রাখার জন্য । গর্তের ঠিক নীচে অনেক অব্যাবহৃত কয়লার গুঁড়ো পরেছিল । হাসপাতাল থেকে রোগীদের সব সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, তাই আর গর্তের ডাকা গুলো দেওয়ার কথা কারু মনে নেই, ঘরে বৃষ্টি ও পরেছে অনেক দেখলাম । হু হু করে বরফের মতন ঠান্ডা হাওয়া আসছিল।
টম হি হি করে কাঁপতে শুরু করল শীতে । এই আবার সুরু হল বলে উঠে ব্যায়াম আরাম্ভ করল টম । হাত নাড়ানো আর শরীর ব্যাঁকানোর তালে তালে টমের জামা সরে সরে যাচ্ছিল আর আমি ওর ফরসা রোমশ বুক দেখতে পাচ্ছিলাম। মাটিতে শুয়ে পরে টাম পা তুলে সাইক্লিং করছিল, তালে তালে অর ভারী পাছা দুলে দুলে উঠছিল ।টমের চেহারা বেশ বড় সর কিন্তু বড্ড থল থলে । আমি মনে মনে কল্পনা করছিলাম টমের থল থলে নরম মাখনের মতন শরীরে কেমন ভাবে বন্দুকের গুলি বা ব্যেয়নেটে মতন ধারাল অস্ত্র ডুকে যাবে । টম এত মোটা না হলে এরকম চিন্তা আমার মাথায় আসতই না ।
আমার নিজের যে খুব একটা ঠান্ডা লাগছিল তা নয়, আমার ্কাঁধ থেকে হাতের আঙ্গুল অব্দি অবস হয়ে গেছিল । মাঝে মাঝে কিসের যেন অভাব বোধ করছিলাম। আমি অন্যমনস্ক হয়ে আমার গরম কোট টা খুঁজছিলাম , হঠাতই মনে পড়ল ওরা আমার কোটাটা ফেরত দেয়নি। আমাদের ভাল জামা , প্যান্ট সবই অরা নিয়ে নিয়েছে, মনে হয় ওদের সৈন্যদের মধ্যে বিলি করবে । আমাদের শুধু সার্ট আর হাসপাতালের রোগীদের পরার মতন সুতির ঢোলা পাজামা দিয়েছে । কিছুক্ষন পর টম উঠে আমার পাশে এসে বসল ।
শরীর গরম হল ?
কিছুমাত্র না, কিন্তু হাঁপিয়ে গেছি ।
আটটা নাগাদ একজন মেজর এল হাতে কিছু কাগজ-পত্র । আমাদের দেখিয়ে একজন রক্ষীকে নাম জানতে চাইল ।
স্টেনবক, ইব্বেতা আর মিরবল ।
চশমাটা ঠিক করে নিয়ে মেজর কাগজে চোখ বোলাল, “স্টেনবক—স্টেনবক, স্টেনবক, ও এই তো, তোমাকে কাল সকালে গুলি করে মারা হবে “ আরো খানিকটা দেখে বল্ল , হ্যাঁ তোমাদের দু-জনের জন্য ও একই শাস্তি ।
যুয়ান বলে উঠল – নানা এ হতে পারেনা । আমার এ শাস্তি হতে পারেনা ।
মেজর অবাক হয়ে যুয়ানের দিকে তাকাল – তোমার নাম কি বলতো ?
যুয়ান মিরবল ।
কিন্তু তোমার নাম আছে এখানে । তোমাকে মৃত্যু দন্ড দেওয়া হয়েছে ।
কিন্তু আমি তো কিছু করিনি- যুয়ান বলল।
মেজর কিছু না বলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে আমার আর টমের দিকে ফিরল ।
তোমরা বাস্কের নিবাসী ?
এখানে কেউ বাস্কের লোক নেই ।
বিরক্ত হয়ে মেজর বলল – আমাকে বলা হয়েছে এখানে তিনজন বাস্কি আছে । আমি তাদের খুঁজে বের করার জন্য সময় নস্ট করতে পারব না। তোমাদের তার মানে কোনো রকম পুরোহিতের সাহায্য লাগবেনা
আমরা কেউ কোনো উত্তর দিলাম না ।
আমরা একজন ডাক্তার পাঠাচ্ছি তোমাদের জন্য আজকের রাতটা তোমাদের সংগে থাকবে। মিলিটারি কায়দার সেলুট করে ফিরে গেল মেজর ।
কি বলেছিলাম আমি । আমাদের দিন শেষ ।
সত্যি , ছেলেটার জন্য এটা ্মোটেই ঠিক হলনা ।
যদিও সৌজন্যের খাতিরে বললাম কথাটা, কিন্তু আমার ছেলেটাকে একদম ই ভাল লাগছিল না ।এমনিতে ছেলেটার মুখটা বড্ড সরু মতন, তার উপর ভয় , আতঙ্কে চোখ-মুখ সব যেন বেঁকে গেছে । দিন তিনেক আগেও বেশ চালাক চতুর ছেলেটাকে আমার মন্দ লাগেনি, কিন্তু এখন ওকে দেখে একটা চিমষে বুড়ো মনে হচ্ছিল । এখন যদি ওকে ওরা নাও মারে, ছেড়ে দেয় তবুও আর কোনো দিন মনে হয় ও ছেলেবেলা ফিরে পাবে । ছেলেটার প্রতি করুনা করতে পারতাম হয়ত- কিন্তু আমি করুনা জিনিষ্টা তীব্র ভাবে ঘৃণা করি। ছেলেটা এখন চুপ করে গেছে, কিন্তু অর চোখ-মুখ, এমন কি হাত পর্যন্ত ফেকাসে হয়ে গেছে । গোল গোল চোখে স্থির দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল ছেলেটা । টমের মনটা খুব নরম, সে ছেলেটার পাশে বসে ওর হাত ধরে সান্ত্বনা দিতে যেতেই ছেলেটা মুখ বিকৃতি করে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিল ।
ওকে একা থাকতে দাও। দেখছনা ও এক্ষুনি কান্নাকাটি শুরু করে ফেলবে ।
অনিচ্ছর সঙ্গে টম ছেলেটার থেকে দূরে এসে বসল । যুয়ানকে সান্ত্বনা দিতে পারলে টম খুশি হত, নিজের কিছুটা সময় কাটত, তাতে করে নিজের পরিনতির কথা না ভেবে থাকতে পারত কিছুক্ষন অন্তত । আমি এর আগে কখন মৃত্যুর কথা ভাবিনি বা ভাবার অবকাশ হয়নি, কিন্তু এখন মৃত্যু আমার শিয়রে আর আমার সে কথা ছাড়া আর কিছু ভাবার ও নেই ।
টম আমাকে জিঞ্জাসা করল আমি কখন কারুকে খুন করেছি কিনা। আমার কাছে কোনো উত্তর না পেয়ে ও বলল টম নাকি এর আগে আগাস্ট মাসের সুরু থেকে ছ-জন কে হত্যা করেছে । টম আমাদের মৃত্যুর অনিবার্যতা অনুভব করতে চাইছিল না, মৃত্যু চিন্তা দূরে রাখার চেষ্টা করছিল । আমি নিজেও ঠিক মতন কল্পনাই করতে পারছিলাম না যে রাত পোহালেই আমরা গুলি বিদ্ধ হয়ে মরতে চলেছি । খুব কি ব্যাথা লাগবে, আমি ভাববার চেষ্টা করছিলআম আগুনের গোলা যখন আমার শরীর ফুটো করে বেড়িয়ে যাবে তখন কেমন মরণ যন্ত্রনা ভোগ করব । এ সবই কিন্তু ভাবের ঘরে চুরি- কারন সত্য একটাই- মৃত্যু আমাদের শিয়রে আর সেটাই একমাত্র সত্য; কিন্তু আমি শান্তই আছি ;সারাটা রাত পরে আছে সত্যের মোকাবিলা করার জন্যে । কিছুক্ষন পরে টম চুপ করে গেল, আমি আড় চোখে ওকে লক্ষ করছিলআম । দেখলাম যুয়ানের মতন টম ও ছাই এর মতন ফেকাসে মেরে গেছে , ওকে সাংঘাতিক বিচলিত দেখাচ্ছিল ; আমি মনে মনে বললাম এই সুরু হল ।ঘরের মধ্য খুবই অন্ধকার, ছাতের ফুটো গুলো দিয়ে আলো এসে পড়ছিল কয়লার গাদার ওপর যেন খোলা আকাশের নীচে একটা বিশ্রী দাগ । আমি ফুটোর মধ্য দিয়ে একটা তারা দেখতে পাচ্ছিলাম , বাইরে রাত্রিটা এখন নিশ্চয় পরিস্কার আর কন কনে ঠান্ডা ।
এমন সময় দরজা খুলে দু-জন রক্ষী একজন সাদা চুলো লোক কে নিয়ে ঘরে ঢুকল । লোকটা একটা বাদামী রঙ্গের পোষাক পরে ছিল । লোকটা আমাদের মিলিটারী অভিভাদন করে বলল –“ আমি ডাক্তার, শেষের এই সময়ে তোমাদের সাহায্য করব বলে এসেছি ।
লোকটার কন্ঠস্বর বেশ ভাল এবং ব্যাক্তিত্বপূর্ন । আমি বললাম – এখানে কি চাই ?
আমি তোমাদের জন্যই এসেছি । শেষের এই সময়টা যাতে তোমাদের কস্ট কম করতে পারি, তাই এসেছি ।
আপনি কেন এসেছেন । আরো অনেক ডাক্তার তো আছেন, হাসপাতাল তো ভর্তি ডাক্তার ।
লোকটা ভাবলেশহীন মুখে বলল – আমাকে এখানে পাঠান হয়েছে । তারপর তাড়াতাড়ি বলল “ও হো, তোমরা ধুমপান করবে ? আমার কাছে সিগারেট আছে, চুরুট ও আছে ।
আমাদের বিলাতী সিগারেট এগিয়ে দিল যদিও আমরা কেউ নিলাম না । আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছি দেখে লোকটা খেপে যাচ্ছে দেখলাম । আমি বললাম “ আপনি মোটাই আমাদের সাহায্য করার উদ্দেশে আসেন নি। তাছাড়া আমি আপনাকে জানি। যেদিন আমি গ্রেপ্তার হলাম সেদিন আমি আপনাকে ফ্যাসিস্টদের কর্মী আবাসে দেখেছি ।
আমি আরো কিছু বলব মনে করেছিলাম, কিন্তু সহসাই আশ্চর্য ভাবেই লোকটার সম্পর্কে সব কৌতুহল শেষ হয়ে গেল । সাধারনত আমি যার পিছনে পড়ি তাকে সহজে ছাড়ি না । কিন্তু কেন জানিনা আমার কথা বলার ইচ্ছাটাই হঠাত ই যেন ফুরিয়ে গেল । আমি শরীর ঝাঁকিয়ে অন্য দিকে চোখ ফেরালাম । হঠাত কি মনে হতে তাকিয়ে দেখি, লোকটা একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে । রক্ষী দুজন মাদুরে বসে ছিল । পেড্রো , রোগা , লম্বা লোকটা তার আঙ্গুল মটকাতে ব্যাস্ত, আর অন্য জন মাঝে মাঝে মাথা নেড়ে ঘুম তাড়াচ্ছিল ।
পেড্রো জিঞ্জাসা করল – আগুন লাগবে ।সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল । আমার মনে হল লোকটা একটা মোটা কাঠের মতনই নীরেট, কিন্তু খুব খারাপ লোক বলে মনে হয় না । ওর শীতল, নীল চোখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল কোনোরকম কল্পনাশক্তির অভাবই ওকে এমন বিরক্তিকর করে তুলেছে । পেড্রো ইতিমধ্যে বাইরে গিয়ে একটা লম্ফ নিয়ে বেঞ্চের একপাশে রেখেছে । খুবই কম আলো , তবু নাই মামার থেকে কানামামাও ভাল। কাল আমাদের সম্পূর্ন অন্ধকার ঘরে রেখে গেছিল । বহুক্ষন আমি একাগ্র ভাবে ঘরের ছাতে লম্ফের আলোর গোল প্রতিবিম্ব দেখছিলাম। আমি মনে হয় আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ।হঠাত চমকে উঠে দেখলাম সেই গোল অলোর বলয়টা অদৃশ্ব হয়ে গেছে, আর জাগরনের আলোয় আসন্ন মৃত্যু আমার সজ্ঞায় সঙ্গায় আমায় যেন পিষে ফেলল ।
মৃত্যু বা ভয় নয়, এ অনুভুতিটার কোনো নাম নেই ।আমার কপাল ,গাল যেন জ্বলছিল, মাথা টা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে যেন । আমি নিজেকে একটা নাড়া দিয়ে আমার দুই বন্ধুর দিকে চাইলাম । দু-হাতে মুখ ঢেকে টম বসে ছিল । আমি ওর মোটা আর ফরসা ঘারটা দেখতে পাচ্ছিলাম । বেচারী যুয়ানের অবস্থা আরও খারাপ । মুখ হাঁ করা, নাকের পাটা দুটো থর থর করে কাঁপছে । অদ্ভুত একটা শীতল চাউনি নিয়ে ডাক্তার উঠে গিয়ে তার পিঠে হাত রাখল , তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য । তারপর লক্ষ করলাম ডাক্তার সাবধানে তার হাত নামিয়ে এনে যুয়ানের স্নায়ু চেপে পরীক্ষা করছে, যদিও যুয়ান কিছুই খেয়াল করছিলনা । ঐ অবস্থাতেই ডাক্তার আমাকে আড়াল করে পকেট থেকে একটা ঘড়ি বের করে স্নায়ু চাপ মেলাচ্ছিল । আমি অবশ্য দেওয়ালের দিকে সরে গিয়ে তার সব কাজকর্মই লক্ষ করছিলাম । লোকটা নিজের জায়গায় ফিরে এসে বসে পড়ল আর হঠাত যেন কি ভীষন দরকারি কথা মনে পড়েছে যেটা এক্ষুনি লিখে রাখতে হবে এমন ভাব করে পকেট থেকে একটা ছোটো খাতা বার করে কিছু লিখল ।“শালা হারামী, আসুক আমার কাছে আমার স্নায়ু চাপ পরীক্ষা করতে , বেটার কদর্য মুখে ঘুষি ঢুকিয়ে দেব “।
লোকটা আমার কাছে না এলেও আমি বুঝতে পারছিলাম আমাকে লক্ষ করছে ; আমি মাথা তুলে ওর দিকে তাকালাম । “তোমার মনে হচ্ছেনা বেশ ঠান্ডা এখানে ।“ অকে দেখে মনে হচ্ছিল খুব শীত করছে, ঠান্ডায় নীলচে হয়ে গেছে ।
আমার ঠান্ডা লাগছেনা মোটেই – বললাম ।
লোকটা আমার থেকে তার দৃষ্টি সরাচ্ছেনা কেন আমি যেন হঠাতই বুঝতে পারলাম আর আমার হাতটা নিজের থেকেই আমার মুখে চলে এল ; আমি ঘামে ভিজে জব জব করছি । এই ঘরে, ভয়ানক শীতে, শৈত্য প্রবাহের মধ্যে আমি ঘামছি ।আমার চুল ঘামে ভিজে আঠা আঠা হয়ে গেছে, হাত চালান যাচ্ছেনা, জামাটা ভিজে গায়ের সংগে সেঁটে গেছে ; গত একঘন্টা ধরে আমি দরদর করে ঘামছি, অথচ কিচ্ছু বুঝতে পারিনি ।কিন্তু এই শালা শুয়ারের চোখে কিছুই এড়ায়নি । আমার গাল বেয়ে ঘাম ঝড়া দেখছিল আর ভাবছিল, এটা হচ্ছে চরম আতঙ্কের বহিঃপ্রকাশ, এমনটাই পড়ায় ডাক্তারি বইতে । নিজের শীত করছে বলে ভাবছিল, ও কতো স্বাভাবিক আছে, কারন ওর মৃত্যু ভয় নেই । একবার ভাবলাম উঠে দাঁড়িয়ে বেটার মুখ ভেঙ্গে দি, কিন্তু সামান্যতম শারীরিক পরিশ্রমেই আমার রাগ, ঘৃণা দূর হয়ে গেল , আর কিছু করবার স্পৃহাই হলনা ,আবার তক্ষুনি হাল ছেড়ে বসে পড়লাম ধপাস করে ।
এখন আমি বুঝতে পারছিলাম আমার চুল বেয়ে টপ টপ করে ঘাম পড়ছে, তাই রুমাল দিয়ে ঘার মুছলাম। কিন্তু অল্পক্ষন পরেই বুঝলাম কোনো লাভ নেই; রুমাল ভিজে চপ চপ করছে, কিন্তু ঘাম কমবার কোনো লক্ষন নেই । আমার পাছাও ঘামছিল আর আমার পাজামা ভিজে মাদুরের সঙ্গে লেপ্টে গেছে ।
যুয়ান হঠাত বলে উঠল- আপনি ডাক্তার ?
হ্যাঁ
খুব কি কষ্ট হয়।। অনেক্ষন সময় লাগে ?
য়্যাঁ, কি, আরে নানা, একদমই নয় । খুব তাড়াতাড়ি সব শেষ হয়ে যায় – এমন ভাবে বলছিল যেন ব্যাঙ্কের গ্রাহক কে বোঝাচ্ছে ।
কিন্তু আমি, ওরা বলছিল, অনেক সময় দু-বার গুলি করতে হয় !
বেলজিয়ানটা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ মাঝে মাঝে প্রথমবার ঠিক জায়গা মতন লাগে না। তারা আবার বন্দুকে গুলি ভরে প্রথম থেকে শুরু করে তাক করতে। একটু ভেবে নিয়ে বলল “ এরকম হলে বেশ সমায় লাগে বৈকি ।
ছেলেটার বয়স কম তাই যন্ত্রনা পাবার ভীষণ ভায় পাচ্ছে । আমি কষ্ট পাবার কথা একেবারেই ভাবছিলাম, ব্যাথা পাবার ভয় আমার ছিল না, আমি অন্য কারনে ঘামছিলাম ।
আমি উঠে কয়লাগাদের দিকে হেঁটে গেলাম । আমার জুতোর ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজে বিরক্ত হয়ে টম একবার তাকাল আমার দিকে । টমের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আন্দাজ করার চেষ্টা করছিলাম যে আমার মুখটাও কি টমের মতন দেখাচ্ছে- সাদা মাটির মতন । টম ও আমার মতন দর দর করে ঘামছিল । আমি মাথা তুলে গর্তের মধ্যে দিয়ে আকাশ দেখার চেষ্টা করলাম । আকাশটা কি সুন্দর। মাথা তুললেই আমি এক টুকর আকাশ দেখতে পাচ্ছি , কিন্তু সেখান থেকে এক কনাও আলো এই অন্ধকার কোনায় এসে পৌঁছাচ্ছিলনা । কিন্তু কাল রাতেও আমি সেই ধর্মস্থানস্থিত কারাগৃহ থেকে বিশাল আকাশ দেখতাম, দিনের এক একটা সময় এক এক রকম স্মৃতি আমার মনে গেঁথে আছে । সকালের স্বচ্ছ নীল আকাশ দেখে আমার এটল্যান্টিক সমুদ্র সৈকতের কথা মনে পড়ত । দুপুরের আকাশ দেখে আমার সেভিলের এক সুঁড়িখানা খানার কথা মনে পড়ছিল, ঠিক এমনি এক দুপুরে সেখানে আমি মদ্যপান করেছিলাম সাথে সুস্বাদু চাট; দুপুর যখন গড়িয়ে যায় সেই সময় ছায়াতে বসে বসে সেই গোল চত্বর মনে করিয়ে দিত, যেখানে আমরা ষাঁড়্রর লড়াই দেখতাম, দিনের এমন সময়টা গোলাকৃত সেই ময়দানটার ঠিক অধের্কটা সুর্যের আলো এসে পড়ত বাকি অধের্কটা অন্ধকার। সত্যি সে ভারী এক বেদনাদায়ক অনুভুতি, এক আকাশ দেখে সাড়া পৃথিবীকে মনে করার চেষ্টা । এখনই বরঞ্চ ভাল আছি, যত খুশী আকাশ দেখিনা কেন, আমার মনকে আর কোনো পূর্বস্মৃতি ছুঁতে পারছেনা । হ্যাঁ এটাই ভাল । আমি ফিরে এসে টমের পাশে বসলাম । দীর্ধ সময় অতিবাহিত হল এক অদ্ভুত নৈঃশ্বব্দতার মাঝে ।
অবশেষে টম খুব নীচু স্বরে কথা বলতে সুরু করল । কথা না বলে থাকতে পারবেনা টম, না হলে নিজেকেই নিজে চিনতে পারবেনা । প্রথমে আমি ভেবেছিলাম টম আমার সঙ্গে কথা বলছে, কিন্তু দেখলাম আমার দিকে তাকাচ্ছেনা । আসলে আমার দিকে তাকাতে সাহস হচ্ছেনা । আমাকে দেখলে ও তো নিজেকেই দেখতে পাবে। আমরা একে অপরের আয়না যেন, ভীত, ত্রস্থ, ঘর্মাক্ত এবং ছাইএর মতন ফেকাসে । তাই সে জীবিত মানুষের দিকে তাকিয়ে ছিল, সেই বেলজিয়ান ডাক্তারের দিকে ।
তুমি কিছু বুঝতে পারছ? আমি তো পারছিনা ।
বেলজিয়ানটার দিয়ে তাকিয়ে আমিও টমের মতন নীচু স্বরে বললাম – কেন কি হয়েছে ?
আমাদের জীবনে এমন একটা কিছু ঘটতে চলেছে, কিন্তু সেটা ঠিক যে কি আমি বুঝতে পারছিনা।
টমের গা থেকে একটা অদ্ভুত গন্ধ আসছিল । গন্ধের ব্যাপারে আমি অনেকের থেকে অনেক বেশী সচেতন । একটু হেসে বললাম – এখনি বুঝতে পারবে ।
এটা পরিস্কার হয়ে গেছে আমার কাছে , ভীষণ জেদের সংগে বলে উঠল , আমি সাহসের সঙ্গে অবস্থার মোকাবিলা করতে চাই, কিন্তু আমাকে তো জানতে হবে কি হতে চলেছে । শোন, ওরা আমাদের চাতালে নিয়ে যাবে, ভাল কথা । তারপর তারা আমাদের সামনে সারি বেঁধে দাঁড়াবে । জান কি ওরা কতজন থাকবে ?
আমি ঠিক জানিনা । পাঁচ থেকে আট জন হবে আর কি। এর থেকে বেশী নয় ।
বেশ। ওরা আটজন আমাদের দিকে বন্দুক তাক করবে । তারপরে কেউ একজন বলবে “ফায়ার “ ওমনি আমি দেখবে আটটা বন্দুক আমার দিকে ফেরান । আমার মনে হবে যেন পিছনের প্রাচীর ভেংগে তার মধ্যে সেঁদিয়া যাই । আমার সর্ব্ব শক্তি দিয়ে আমার পিছনের প্রাচীর ঠেলতে থাকব , কিন্তু একটা মুর্তিমান দুঃস্বপ্নের মতন দেয়ালটা অচল দাঁড়িয়ে থাকবে তার জায়গায় । আমি সব কল্পনা করতে পারছি । তুমি যদি জানতে আমি কত নিখুত ভাবে সব কল্পনা করতে পারি !
ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমিও কল্পনা করতে পারছি ।
নিশ্চয় ভযানক যন্ত্রনা হবে । তুমি জাননা বোধ হয় ওরা প্রথমে আমাদের চোখ, মুখ তাক করে গুলি চালাবে, আমাদের শরীর বিকৃত করবার জন্য । প্রচন্ড ঘৃণা সহকারে কথাটা বলল । আমি এখনি যন্ত্রনা অনুভব করতে পারছি । গত এক ঘন্টা ধরে আমি আমার মাথায়, ঘারে যন্ত্রনা ওনুভব করছি । আসল যন্ত্রনা নয় তার থেকেও কনেক খারাপ । কাল আমি এরকম যন্ত্রনা পাব- তারপর, তারপর কি হবে ?
আমি খুব ভাল করেই বুঝতে পারছিলাম ও কি বলতে চাইছে । কিন্তু আমার বুঝতে ইচ্ছা করছিল না । গত এক ঘন্টা ধরে আমিও সারা দেহে অগুন্তি ক্ষতের যন্ত্রনা অনুভব করছিলাম । কিন্তু টমের মতনই আমি সেই যন্ত্রনা বোধের জন্যে বিচলিত হচ্ছিলাম না একটুও । আমি বললাম – তারপর তুমি চোখে সরষেফুল দেখবে ।
বেলজিয়ান ডাক্তারের ওপর থেকে চোখ না সরিয়েই আবার নিজের মনে বক বক শুরু করল টম। বেলজিয়ানটা আমাদের কথায় কান দিচ্ছিল বলে মনে হচ্ছিল না। আমি জানি, আমরা কি ভাবছি তাই নিয়ে বেটার কিচ্ছু যায় আসেনা। ও আসলে এখানে এসেছে মজা দেখতে, দেখতে কি করে তিনটে তাজা প্রাণ মৃত্যুর আগেই কেমন ভাবে তিল তিল করে শেষ হয়ে যাচ্ছে ।
টম বলছিল এটা একটা দূঃস্বপ্নের মতন মনে হচ্ছে । আমি বোঝবার চেষ্টা করছি, মনে হচ্ছে যেন একটা ধারনা হচ্চে , ধীরে ধীরে পরিস্কার হচ্ছে ব্যাপারটা , কিন্তু হঠাতই দেখছি আমি যে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই আছি, আবছা মতন যে ছবিটা চোখের সামনে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছিল সেটা কোথাও মিলিয়ে গেছে । আমি আমার ্মন কে বোঝাচ্চি যে মৃত্যুর পরে কিছু থাকবেনা, কোনো অস্তিত্বই থাকবেনা- কিন্তু আমি ঠি মতন অনুধাবন করতে পারছিনা, সেই অবস্থাটা, যেখানে কিছু নেই, আমি নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় যেন একটু একটু ধারনা করতে পারছি, আবার যেমন তোমাকে বললাম সব কিছু কেমন গুলিয়ে যায়, আর সেই পুরোনো ব্যাথার আর যন্ত্রনার, সেই গোলা গুলির উপলব্ধি ফিরে আসে । আমি একজন প্রখর বাস্তব বাদী, মাইরি বলছি, আমি পাগল হয়ে যাচ্চিনা । আমি আমার মৃত দেহ মানস চোখে দেখতে পাচ্চি , সেটা এমন কিছু শক্ত ব্যাপার নয়, কিন্তু আমি নিজের চোখে আমার মৃত শরীর পরে থাকতে দেখছি, ভাব!
আমার ভাবতে হবে যে আমি আর নেই, আমি আর কিছু দেখতে বা শুনতে পাচ্ছিনা, কিন্তু আর সবই ঠিক আগের মতন থাকবে, জগত তার নিজের মতন চলবে, আমার চেনা , অচেনা সবাই বেঁচে থাকবে, দেখবে , শুনবে । কিন্তু, প্যাবলো, তুমি মানোতো যে আমরা এরকম ভাবে চিন্তা করতে অভ্যস্ত নই , এটা আমাদের জন্যে স্বাভাবিক চিন্তা নয়। আমি ইতি মধ্যেই সারারাত জেগে একটা কিছুর জন্যে অপেক্ষা করছি, কিন্তু এমন একটা কিছুর জন্যে নয়, যেটা চুপি চুপি, ধীরে ধীরে, পিছন থেকে এসে আমাদের গ্রাস করবে ।। প্যাবলো আমরা এককম একটা কিছুর জন্যে কেমন করে প্রস্তুত হব বলতো ।
“উফ, তোমার মুখ বন্ধ করবে নাকি পুরোহিত ডাকবো “
অনেক্ষন ধরে লক্ষ করছিলাম টম একটা ভাবলেশহীন মুখ করে েএকটানা বকে ছলেছে, যেন সে এক ভবিষ্যত দর্ষা, আর আমাকে প্যাবল বলে সম্মোধন করছে । আমার একটুও ভাল লাগছিলনা, কিন্তু কি আর করা আইরিশ রা সব একই ধরনের হয় দেখছি । আমার কিরকম যেন মনে হচ্ছিল যে টমের গা থেকে পেচ্ছাপের গন্ধ আসছিল । কার্যত টমের জন্য কোন বিশেষ সহানুভুতি আমার ছিল না, কেনই বা থাকবে, আমরা দুজনেই তো একই পথের যাত্রী, এক সঙ্গে মরতে চলেছি । অন্য কেউ , যেমন ধরা যাক রোমান গ্রুস, যদি আমার সঙ্গী হত তাহলে ব্যাপারটা অন্য রকম হত । কিন্তু যুয়ান আর টমের সঙ্গে আমি কোনো রকম সহমর্মিতা অনুভব করছিলুম না । নিজেকে দু-জনের মাঝখানে খুব একা লাগছিল- কিন্তু এই বেশ, এই ভাল । যদি এখানে আমার সঙ্গে রামন গ্রিস থাকত, তাহলে আমি অনেক বেশি বিচলিত হতাম, অনেক বেশি যন্ত্রনা অনুভব করতাম । আমি এখন খুব বেশি কঠিন নির্দয় অবস্থায় আছি , আর এককম ই থাকতে চাই আমি ।
আমি বুঝতে পারছিলাম, টম নিজেকে ব্যাস্ত রাখার জন্য ক্রমাগত কথার জাবর কাটছিল, যেন ওবধারিত মৃত্যুর চিন্তা তার মনে না স্থান পায় । ওর গায়ের থেকে বিচ্ছিরী রকমের পেচ্ছাপের গন্ধ আসছিল, সাধারনত প্রস্টেট গ্ল্যান্ড দুষ্ট রোগীদের কাছ থেকে পাওয়া যায় । আমি ওর সঙ্গে সম্পুর্ন এক মত, আমাদের মৃত্যু মোটেই স্বাভাবিক নয় । এবং যেহেতু আমি মরতে চলেছি , আমার কাছে কিছুই স্বাভাবিক লাগছিলনা, ঘরের কোনায় রাখা কয়লার গুঁড়, সামনের বেঞ্চিটা, বা পেড্রোর কুৎসিত মুখ । কিন্তু এই যে সারারাত ধরে আমি আর টম একই রকম চিন্তা করছি, একই ভাবে, সেটা আমায় কুরে কুরে খাচ্ছিল। আমি আড় চোখে টমের দিকে তাকালাম, ওকে কেমন যেন অন্যরকম লাগছিল, মনে হচ্ছিল ওর মুখের প্রতিটি রেখায়, প্রতিটি কম্পনে আসন্ন মৃত্যুর কথা লেখা আছে । আমার অহঙ্কার, আমার আত্মস্নমান, তলানি তে গিয়ে ঠেকেছে । গত চব্বিশ ঘন্টা আমি ওর পাশে বসে কাটিয়েছি, ওর প্রতিটি আক্ষেপ শুনেছি, ওর সঙ্গে কথা বলেছি আর আমি খুব ভালই বুঝতে পারছিলাম আমাদের মধ্যে কোনো মিল নেই । কিন্তু এখন ওর দিয়ে তাকিয়ে আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম যে আমাদের মধ্যে এখন এমন একটা আশ্চর্য মিল দেখা যাচ্ছে, যাতে করে যে কেউ আমাদের যমজ ভাই বলে ভাবতে পারে, কারন আমরা দু-জনে একই সাথে মরতে চলেছি, আর আমাদের দু-জনের চোখে মুখে সেই কথা স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে ।
আমার হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে, আমার দিকে না তাকিয়ে বলল টম- “প্যাবলো, আমি ভাবছি, এটা কি সত্যি যে সব কিছু শেষ হতে চলেছে,
ঝট করে আমার হাত্ সরিয়ে নিয়ে আমি বললাম- শালা শুয়ার নিজের দু-পায়ের ফাঁকে তাকিয়ে দেখ আগে ।
টমের দু-পায়ের নিচে জল, আর ওর পাজামার তলা থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছিল ।
বিস্ফারিত চোখে টম বলে উঠল- এটা কি ?
তুমি পাজামায় পেচ্ছাপ করেছ ।
নানা কক্ষোন নয় । এটা আমি করিনি ।আমি তো কিছু বুঝতেই পারিনি- চেঁচিয়া উঠল টম ।
বেলজিয়ানটা দূর থেকে আমাদের লক্ষ করছিল, এখন এগিয়ে এসে সমবেদনার ভান করল – তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে ?
টম চুপ করেছিল । বেলজিয়ানটা জলের দিকে তাকিয়ে কিছু বলল না ।
ভীষণ হিংস্রভাবে টম বলল – আমি জানিনা এটা কি । কিন্তু আমি একটুও ভয় পাইনি। মাইরি বলছি আমি ভয় পাচ্ছিনা ।
বেলজিয়ানটা এ কথার কোনো উত্তর করলনা । টম উঠে কোনায় গেল নিজেকে হাল্কা করতে ।পাজামার বোতাম লাগাতে লাগাতে ফিরে এল আবার আর নিরুত্তরে নিজের জায়গায় বসে পড়ল । বেলজিয়ানটা খাতায় লিখছিল ।
আমরা তিনজনেই তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, কারন সেই একমাত্র ্সত্যিকারের জীবিত ব্যাক্তি আমাদের মধ্যে । এই লোকটার হাঁটা-চলা, কথা বলা সব কিছুর মধ্যেই একজন জীবিত প্রাণী কে দেখতে পাচ্ছিলাম । ও একজন সুস্থচ স্বাভাবিক লোকের মতনই ঐ ঠান্ডা কনকনে ঘুপচির মধ্যে শীতে কাঁপছিল, ওর শরীর ওর নিজের বশে । বাকী আমরা কজন আমাদের শরীরকে অনুভব ই করতে পারছিলাম না, অন্তত লোকটার মতন করে তো নয়ই । আমার মনে একটা ইচ্ছে মাঝে মাঝেই দানা বাঁদছিল, যে দুপায়ের ফাঁকে আমার পাজামাটা স্পর্শ করি, কিন্তু সাহস হচ্ছিল না । আমি বেলজিয়ামটাকে দেখছিলাম কেমন নিজের শরীর নিজেই চালনা করছিল, কেমন সুদৃঢ় পদক্ষেপে নিজের শরীর কে বহন করছিল, একজন স্বাভাবিক লোক যে কালকের কথা নির্দ্বিধায় চিন্তা করতে পারে । আমরা যেন তিন নীরক্ত ছায়া শরীর, জীবিত লোকটার দিকে তাকিয়ে লুব্ধ অভুক্ত রক্ত চোষা বাদুরের মতন ওর জীবন বিন্দু বিন্দু পান করছিলাম ।
অবশেষে লোকটা ছোট্ট যুয়ানের কাছে গেল । এখন ও কি কোনো এক ডাক্তারি ঙ্গান চরিতার্থ করতে গেছে, নাকি নেহাত ই দয়াপরবস হয়ে। যদি তাই হয়, তাহলে বলতেই হবে আজ রাতে এই প্রথমই সে কোনোরকম মানবিক আচরন করছে ।
ছেলেটার মাথায়, ঘারে সস্নেহে হাত বোলাতে লাগল। ছেলেটা প্রথমটা একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে ছিল , তারপর হঠাত তার হাতটা টেনে নিয়ে অদ্ভুত ভাবে দেখতে থাকল। বেলজিয়ানের হাতটা তার দুহাতের মধ্যে ধরা ছিল, মনে হচ্ছিল যেন দুটো ছাই রঙ শাঁড়াষির মাঝখানে ধরা একটা গোলগাল বাদামী পুরুষ্টু হাত । আমি যা সন্দেহ করছিলাম তাই হল, টমও মনে হয় এই ভায়টাই পাচ্ছিল, কিন্তু বেলজিয়ানটা কিছুই আন্দাজ করতে পারেনি তাই বেশ একটা সস্নেহ হাসি নিয়ে ছেলেটার কার্যকলাপ দেখছিল । তাকে চমকে দিয়ে যুয়ান তার হাতটা মুখের কাছে এনে কামড়ে দেবার চেষ্টা করল । ছিটকে সরে গিয়ে পিছনে দেওয়ালে ধাক্কা খেল লোকটা। এক মুহুর্তের জন্য আমাদের তিনজন কে সভয়ে দেখে নিল সে । এতক্ষনে সহসাই এটা তার মাথায় ঢুকল যে আমরা ওর নিজের মতন স্বাভাবিক মানসিক অবস্থায় নেই । আমি প্রচন্ড জোরে হাসতে সুরু করতে একজন রক্ষি লাফিয়ে উঠল, আর একজন ঘুমাচ্ছিল তার সদ্য ঘুম ভাঙ্গা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল ।
আমি একই সঙ্গে অনেকটা হাল্কা আর বেশ চঞ্চল বোধ করছিলাম । আমি আর কাল ভোরের কথা বা আসন্ন মৃত্যুর কথা ভাবতে চাইছিলাম না । কোনো মানে হয়না । শুধু কতগুল শব্দ, যা কোনোই অর্থ বহন করে না । কিন্তু যতবারই আমি অন্য কিছু ভাববার চেষ্টা করছিলাম, আমি আমারদিকে তাক করা বন্দুকের নল দেখতে পাচ্ছিলাম । আমি এক রাতের মধ্যে অন্তত কুড়িবার আমার মৃত্যুকে অনুভব করেছি, একবার তো আমি ভেবেছিলাম ঘটনাটা বাস্তবেই ঘটছে, কল্পনা নয়, মানে আমি বোধ হয় একটু সময়ের জন্যে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। মনে হল ওরা আমাদে হির হির করে টেনে নিয়ে দেওয়ালের গায়ে দাঁড় করিয়ে দিল, আমি নিজেকে ছাড়াবার প্রানপন চেষ্টা করছিলাম, আমাকে প্রানদান করার জন্য সকাতরে অনুনয় করছিলাম ‘ এমন সময় চমকে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল । দেখলম বেলজিয়ানটা আমার দিকে তাকিয়ে। আমি কি কোনো রকম শব্দ করেছি ঘুমের মধ্যে। না লোকটা কিছু খেয়াল করেনি নিজের মনে গোঁফ পাকাচ্ছে দেখলাম । চেষ্টা করলে আর একটু ঘুমাতে পারতাম । পুরো আটচল্লিশ ঘন্টা ঘুমায়নি । প্রবল ভাবে পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত ।
কিন্তু জীবনের শেষ দু-ঘন্টা আমি গুমিয়ে নষ্ট করতে চাই না; ওরা যখন আমকে ভোর বেলায় ডাকতে আসবে তখন আমি প্রায় অচেতন অবস্থায় মৃত্যুর মোকাবিলা করব, হয়ত একবার উঃফ বলার অব্দি সুযোগ পাবনা । আমি তা চাইনা । আমি একটা জন্তুর মতন মরতে চাইনা, আমি আমার মৃত্যু কে জানতে চাই, বুঝতে চাই। তাছাড়া এখন ঘুমালে আবার এরকম দুঃস্বপ্ন দেখতে পারি, এ ভয় ও ছিল । আমি উঠে পায়চারি করতে লাগলাম । নিজের চিন্তাটাকে ফেরাবার জন্য আমার অতীত জীবনের কথা মনে করার চেষ্টা করছিলাম । একরাশ স্মৃতি হুড় হুড় করে সামনে এসে দাঁড়াল । কিছু সুখের, কিছু দুঃখের স্মৃতি, অন্তত একসময় এরকমই ভাবতাম আমি । কিছু মুখ, কিছু ঘটনা আমার চোখের সামনে দ্রুত ভেসে উঠছিল, যেমন সেই অল্প বয়সী বুল-ফাইটার যাকে রক্তাক্ত হতে দেখেছিলাম, আমার এক প্রিয়া কাকার মুখ, রামন গ্রাসের মুছ। আমার বিগত জীবনের কথা বিচ্ছিন্ন ভাবে মনে পড়ছিল ।আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল ১৯২৬ সালে পুরো তিনটে মাস আমার কোনো কাজ ছিল না । টাকার অভাবে আমার খাওয়া জুটতনা । একবার পর পর তিন দিন আমি অভুক্ত অবস্থার রাস্তার বেঞ্চে শুয়ে কাটিয়েছি । আমি মৃত্যুর সংগে যুদ্ধ করেছি, কারন আমি মরতে চাইনি, নিজের দুর্দশায় কি পরিমান ক্রুদ্ধ ছিলাম, ভেবে আমার এখন হাসি পাচ্ছে । আমি কি পাগলের মতন সুন্দরীদের পিছনে, অর্থের জন্য আর মুক্তির জন্য দৌড়ে বেড়িয়েছি। কারন আমি তখন আমার দেশ স্পেন কে মুক্ত করার স্বপ্ন দেখছিলাম । আমি নেতা মারগালের মুগ্ধ ভক্ত ছিলাম আর তার বিপ্লবী য়ান্দোলোনে যোগ দিয়েছিলাম । তখন আমি জনসভায় ভাষণ দিচ্ছি । আমি এমনভাবে সব কিছুর সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে রেখেছিলাম যেন আমি অমর, চিরকাল থাকব ।
সে সময় আমি ভাবতাম আমার সমনে আমার সারা জীবন পরে আছে। এখন আমি বুঝেছি এটা কতবর মিথ্যা, অর্থহীন ভাবনা । এ জীবনের কোনো অর্থ নেই, কারন এটা শেষ হয়ে যাবে । এক সময় আমি কত নারী সঙ্গ করেছি, তাদের সঙ্গে হেঁটেছি, গল্প করেছি , কত মুল্যবান সময় কাটিয়েছি । তখন যদি জানতামি আমার এই পরিণতি হবে তাহলে আমি আমার কড়ে আঙ্গুল ও নাড়াবার শক্তি পেতাম না । আমার জীবনের দরজায় তালাচাবী পড়ে গেছে, অথচ তার ভিতরে সবই অসমাপ্ত, সব কাজ, সব ইচ্ছা, সব আশা অপূর্ণ রয়ে গেছে । এক মুহুর্তের জন্য আমার মনে হল জীবন কি সুন্দর। কিন্তু আমি সে ভাবে কিছুই বলতে পারবনা জীবন সম্মন্ধে , কারন জীবন নামক বস্তুটা অজানা অধরা থেকে গেছে, যেন একটা আবছা পেনসিলে আঁকা ছবি, তার মধ্য কিছুই বিশেষ ভাবে মূর্ত নয়, আমি এই আদি-অন্তহীন কালের একটি কনা মাত্র বেঁচেছি, তাকে কিছুই বুঝিনি, সে আমার বোঝার বাইরে । আমি আর কিছুর ই অভাব বোধ করছিনা । কত কিছুই আমার চাইবার ছিল, দেখবার ছিল, জানবার ছিল, কিন্তু আসন্ন মৃত্যু আমার মধ্যে আর কোনো আকাঙ্খা অবশিষ্ঠ রাখেনি ।
হঠাত করে বেলজিয়ানের মাথায় একটা নতুন বুদ্ধি এল- সে বলল যদি সেনা আদালত অনুমতি দেয় তাহলে আমি তোমাদের প্রিয়জনের জন্য তোমাদের শেষ বার্তা বা উপহার পৌঁছে দিতে পারি ।
টম বির বির করে বলল “আমার কেউ নেই”
আমি চুপ করে আছি দেখে আমার দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি দিয়ে টম জিগ্যাসা করল – কঞ্চা কে কিছু বলার নেই তোমার ?”
“না”
আমার নিজের ওপর খুব রাগ হচ্ছিল , কেন যে কাল রাতে কঞ্চার কথা টমকে বলতে গেলাম । আমি একবছর কঞ্চার সঙ্গে থেকেছি । কাল আমার এত মন খারাপ লাগছিল যে আমি কঞ্চাকে আর একবার দেখবার জন্য আমার ডান হাতটা পর্যন্ত বিসর্যন দিতে পারতাম । কিন্তু আজ আমার মধ্যে কঞ্চার জন্য কোনো রকম আকর্ষন অবশিষ্ট নেই । আজ যদি আমার সামনে এসে দাঁড়ায় ওকে বুকে টেনে নেবার কোন রকম ইচ্ছাই আমার হবে না । আমার নিজের ঘর্মাক্ত নোংরা শরীরটা কে আমার ঘৃণা হচ্ছে, এমনকি কঞ্চার শরীরটাও যে আমাকে বিব্রত করবে না সে বিষয়েও আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম না । আমার মৃত্যুর কথা জানতে পারলে কঞ্চা খুব কাঁদবে, অনেক দিন পর্যন্ত তার জীবনের প্রতি সব আকর্ষন চলে যাবে , আমি জানি । তবুও শেষ কথা হল, সে জীবিত থাকবে আর আমার সামনে নিশ্চিত মৃত্যু । কঞ্চার নরম , সুন্দর দুটি চোখের কথা আমার মনে পড়ে গেল । ঐ চোখে যখন আমার দিকে তাকাত সেই দৃষ্টি আমার অস্তিত্ব ছুয়ে যেত । কিন্তু আমি জানি সে সব কিছু শেষ হয়ে গেছে । কঞ্চার দৃষ্টি আর আমাকে ছুঁতে পারবে না, আমি একা, সম্পুর্ণ একা ।
টমও একা তবে আমার সঙ্গে একটু পার্থক্ব আছে । কাঁচি-পায়ে বসে টম কেমন একটা অদ্ভুত হাসি হাসি মুখে সমনের বেঞ্চিটার দিকে তাকিয়ে ছিল । খুব সাবধানে আলতো করে হাত রাখল বেঞ্চিটার ওপর যেন কিছু ভেঙ্গে যেতে পারে, তার পরেই কেঁপে উঠে হাত সরিয়ে নিল। আমি হলে এরকম করতাম না । আইরিশ লোকেরা কেমন যেন । আজ এখানে সব কিছুই আমার কাছেও নতুন এবং অন্য রকম প্রতিভাত হচ্ছিল , সব কিছুই যেন ভঙ্গুর তাদের ঘনত্বও আমার চোখে কম বলে মনে হচ্ছিল বেঞ্চি , লম্ফ, কয়লার গাদা সব কিছু যেন আমার থেকে তাদের দুরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছে । আমি তো মরে যাব আর এরা যেন মৃত্যুপথযাত্রীর রোগীর শয্যার পাশে বসে নিজেদের মধ্যে ফিস ফিস করে কথা বলছে । টম বেঞ্চিতে হাত দিয়ে অদূরবর্তী সময় সেখানে নিজের অভাবটাই অনুভব করেছে ।
এখন যদি কেউ এসে আমাকে বলে যে আমাকে তারা বাড়ি ফিরে যাবার অনুমতি দেবে, আমার জীবন পুরপুরি ফিরিয়ে দেবে, তবুও আমি কনামাত্র উদবুদ্ধ হব না। মৃত্যু অবশম্ভাবী জেনে, আরো কিছূ ঘন্টা বা কিছু বছর বেশী বেঁচে থাকাটা আমাকে বেশী সোয়াস্ত্বি দিতে পারবেনা । আমি এই নশ্বরতাকে আঁকড়ে ধরে বসে ছিলআম, আর তাতে একধরনের শান্তি ও অনুভাব করছিলাম । কিন্তু এ শান্তি সুখকর নয়, কারন আমার শরীর, আমি এই শরীর দিয়ে দেখছি, শুনছি, কিন্তু শরীরটা তে আমি আর একাত্ম বোধ করতে পারছিলাম না । আমার শরীর কাঁপছে, ঘামছে, কিন্তু আমি সেটা বুঝতে পারছিনা, শরীর আমার বশে নেই, শরীরের বিভিন্ন জাগায় হাত দিয়ে অনুভাব করে বুধতে হচ্ছে সেখানে কি হচ্ছে, যেন অন্য কারো শরীর। কিছু সময় অবশ্য শরীরের উপস্থিতি টের পাচ্ছিলাম, যেমন মাঝে মাঝে ডুবন্ত মানুষের অনুভুতি টের পাচ্ছিলাম, যখন একটা ঊড়োজাহাজের যাত্রীরা অনুভাব করে, যখন সেটা হঠাত মাথা নিচু করে ঝাঁ করে নিচে নামে, বা আমার হৃদস্পন্দন । কিন্তু এতে আমার কিছু সুবিধা হচ্ছিলনা। কারন সময় সময় আমার শরীর আমাকে দুঃসংবাদ পাঠাচ্ছিল । যখন শরীর চুপচাপ থাকছিল তখন আমার শরীর কে কেবল একটা ভার বলে টের পাচ্ছিলাম । আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন এক অতিকায় ঘৃণ্য পোকার সঙ্গে বাঁধা রয়েছি । একবার আমার পাজামায় হাত দিয়ে দেখলাম সেটা ভেজা ভেজা; যদিও বুঝিনি সেটা ঘাম না পেচ্ছাপ তবু সাবধানতার খাতিরে কয়লার গাদায় নিজেকে হাল্কা করতে গেলাম ।
বেলজিয়ান তার ঘড়ি হাতে নিয়ে দেখে বলল- একন সারে তিন্টে বাজে ।
শুয়োরের বাচ্চা , ইচ্ছা করে বলল । টম লাফিয়ে উঠল ; খেয়াল করেনি যে সময় শেষ হতে চলেছে । রাত্রিটা েএতক্ষন আমাদের কাছে একটা আকার অবয়বহীন ঘন অন্ধকার প্রতিভাত হচ্ছিল । কখন যে শুরু হয়েছিল সেটাও মনে করতে পারছিনা ।
ছোটো ছেলে যুয়ান কাঁদতে শুরু করল। দু হাত রগরাতে রগরাতে অনুনয় করতে লাগল – আমি মরতে চাইনা, আমি মরতে চাইনা । সারা ঘরময় দু-হাত মাথার উপর করে দৌরে বেড়াল তার পর দড়াম করে একটা মাদুরে শুয়ে ভীষণ কান্নাকাটি জুরে দিল । টম দুঃখী দুঃখী চোখে দেখছিল, কিন্তু সান্ত্বনা দেবার কোনো চেষ্টা করলা না। কারন সেটা বৃথা , ছেলেটা এত চেঁচা মিচি, কান্নাকাটি করছিল কিন্তু ঠিক ততটা গভীর উপলব্ধি হয়নি । কোনো রোগীর জ্বর হলে যেমন তাকে অনেক সহজে রোগী যুঝতে পারে, যে রোগের কোনো বহিঃপ্রকাশ নেই সে রোগ অনেক বেশি মারাত্মক হয়ে ।
ছেলেটা কেঁদে চলেছে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম নিজের দুঃখে চোখের জল ফেলছে, এখনো মৃত্যুর স্বরূপ ও বুঝে উঠতে পারেনি । এক মুহুর্তের জন্য, খুব সামান্য এক সেকেন্ডের জন্য আমিও নিজের দুঃখে চোখের জল ভাসবার উপক্রম করেছিলাম । কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ঠিক তার বীপরিতটাই হল । দেখলাম কি বিশ্রীভাবে ছেলেটার সারা শরীর তার কান্নার তালে তালে দুলে দুলে উঠছে । আমার অমানুষিক ঘৃণার উদ্রেক হল । আমি করুনা ঘৃণা করি, অপরের প্রতি বা নিজের প্রতি কোনো ভাবেই আমি করুনা করা পছন্দ করিনা । আমি নিজেকে বোঝালাম – আমি পরিস্কার ভাবে মরতে চাই ।
টম উঠে ছেঝের গোল গর্তের নীচে দাঁড়িয়ে দিনের আলোর অপেক্ষায় তাকিয়ে রইল ।আমি মনকে কঠিন করে নিয়েছিলাম যে আমার মৃত্যু সহজ, সরল, পরিস্কার হবে , আমি আর কোনো কথা ভাবছিলাম না । কিন্তু যে মুহুর্তে বেলজিয়ান্টা সময়টা বলেছিল – আমার মনে হচ্ছিল সময় যেন উড়ে চলেছে, বিন্দু বিন্দু করে শেষ হয়ে আচ্ছে ।
বেশ অন্ধকারের মধ্যেই আমি শুনলাম টম বলছে- শুনতে পাচ্ছ পায়ের আওয়াজ ।
হ্যাঁ।
বাইরে সৈন্য মার্চ করার শব্দ আসছিল ।
কি করছে ওরা এখন । অন্ধকারে কি করে গুলি করবে ?
কিছুক্ষন পর বাইরে শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। আমি টম কে বললাম- সকাল হয়ে গেছে ।
ঘরের মধ্যেটা ছায়া ছায়া লাগছিল ।
বাইরে তখন গুলির আওয়াজ শুরু হয়ে গেছে ।
টম কে বললাম- ওরা শুরু করে দিয়েছে । নিশ্চয় পেছনের চাতালে আওয়োযন করেছে ।
টম ডাক্তারটার কাছে একটা সিগারেট চাইল । আমার এখন ধুমপান বা মদ্যপান কিছুই করতে ইচ্ছা করছেনা । তখন থেকে গুলির আওয়াজ আর বন্ধ হলনা ।
বুঝতে পারছ কি হচ্ছে বাইরে? টম জিগ্যাসা করল ।
আরো কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু চুপ করে গেল, কেননা দরজাটা বাইরে থেকে কেউ খুলছিল । একজন অফিসার , চারজন দলীয় কর্মী নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল , দেখে টম সিগারেটটা মাটিতে ফেলে দিল ।
শ্তেনবক?
টম উত্তর দিল না। পেড্র টমকে দেখিয়ে দিল ।
যুয়ান মিরবাল?
মাদূরের ওপর আছে ।
উঠে দাঁড়াও- অফিসার বলল।
যুয়ান নড়লনা দেখে দুজন কর্মী ওকে দুটো হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিল । কিন্তু হাত ছেড়ে দিতেই আবার ধপাস করে বসে পড়ল যুয়ান ।
ওরা দুজন ওর অবস্থা দেখে ইতস্তত করছে দেখে , অফিসার বলল –তোমরা কি প্রথম অসুশ্ত লোক দিখছ ! তোমরা ধরে নিয়ে যাও। বাইরে ওরা ঠিক ব্যাবস্থা করে নেবে । টমের দিকে ফিরে বলল “চল “
টমকে মাঝখানে নিয়ে দুজন কর্মী বেড়িয়ে গেল ।
বাকী দুজন যুয়ানকে পাঁজাকোলা করে ধরে নিয়ে গেল। যুয়ানের গ্যাঁন ছিল। ফ্যাল ফ্যাল করে তিকিয়ে ছিল, আর োর বড় বড় দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরছিল । আমি ও ওদের অনুসরন করতে উদ্যত হলাম – কিন্তু অফিসারটি আমাকে থামাল ।
তুমি ইব্বিয়েতা?
হ্যাঁ ।
তুমি এখানে অপেক্ষা কর তোমাকে ওরা একটু পরে নিয়ে যাবে ।
সবাই চলে গেছে। বেলজিয়ান ডাক্তার আর দু জন রক্ষীও নেই । আমি একেবারে একা বসে আছি। আমাকে নিয়ে কি করবে বুঝতে পারছিলাম। অদের সঙ্গে আমাকেও একবারে মেরে ফেললেই ভাল হত। বসে বসে অনবরত গুলির শব্দ শুঞ্ছিলাম আর প্রতিটি শব্দের সাথে সাথে সারা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছিল । আমার মনে হচ্ছিল চিতকার করি, আর দু-হাতে আমার চুল ছিঁড়ি ।
প্রায় এক ঘন্টা পরে ওরা এসে আমাকে দু-তলার একটা ঘরে নিয়ে গেল । ঘরটা বেছ ছোটো আর চুরুটের ধোঁইয়ায় আচ্ছন্ন । ঘরটা ভ্যাপসা গরমও । দুজন অফিসার চেয়ারে বসে চুরুট খাচ্চিল, তাদের হাঁটুর ওপর কিছু কাগজ পত্র ।
তুমি ইব্বেতিয়া
হ্যা
রামন গ্রস কথায় ?
আমি জানিনা ।
আমাকে যে প্রশ্ন করছিল লোক্টা বেশ বেঁটে আর মোটা। চশমার পিছন থেকে তার কঠিন চোখ আমাকে দেখছিল । এদিকে এস ।
গেলাম ।
উঠে দাঁড়িয়ে আমার হাতদুট নিজের হাতে নিয়ে আমার দিকে এমন একটা দৃষ্টি নিক্ষেপ করল , যেটা অন্য সময় হলে আমাকে মাটির সংগে মিশিয়ে দেতে সক্ষম হত । সর্বশক্তি প্রয়োগ করে আমার উপর হাতে সে চিমটি কাটল । আমাকে যন্ত্ররনা দেবার অভিপ্রায় নয়, এটা যেন একটা খেলা । ও আমাকে দাবাতে চাইছিল । এছাড়া দুর্বিত্তটা আমার মুখের ওপর তার পুতিগন্ধ ময় নিঃশ্বাস ত্যাগ করছিল । বেশ কিছুক্ষন আমরা ঐ ভাবে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিলাম, একে অপরে চোখের দিকে তাকিয়ে , আর আমার অসম্ভাব হাসি পেতে লাগল । যে লোকটা মরতে চলেছে তাকে কি অত সহজে দাবান যায় ? অগত্যা আমাকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে, নিজের চেয়ারে বসে পড়ল ।
রামনের জীবনের বিনিময়ে তোমার জীবন । যজি বল কোথায় লুকিয়ে আছে, তবে তোমার জীবন ফিরে পেতে পার ।
এই লোকগুলো দামী দামী পোষাক পরে এখানে বসে আছে, কিন্তু এরাও তো মরতে চলেছে । হয়ত আমার মৃত্যুর পরে, কিন্তু ওদেরও জীবন ক্ষনস্থায়ী । ওরা কাগজে নাম খুঁজছে, কাদের মারবে, কাদের বন্দী করবে । ওরা এই দেশের ভবিষ্যত, এখানকার নাগরিকদের ভবিষ্যতের মালিক মনে করছে নিজেদের । ওদের এই সব কার্য-কলাপ কি অকিঞ্চিতকর, কি হাস্যকর । আমার মনে হচ্ছিল এরা সব পাগলের দল ।
বেঁটে লোকটা এখনও আমার দিকে তাকিয়ে আছে । ওর প্রতিটা অঙ্গভঙ্গী দেখে মনে হয় সব মেকী, আমাকে দেখাবার জন্য যে সে কতটা হিংস্র জন্তু ।
তাহলে? বুঝতে পেরেছ ?
আমি জানিনা কোথায় আছে গ্রস । আমি যতদুর জানতাম ও এখন মাদ্রিদে আছে ।
অন্য লোকটা এবার তার হাতটা সামান্য নাড়াল । আমি ওদের সব চালই বুঝতে পারছিলাম আর স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছিলাম যে মানুষ এত নোংরা খেলাও খেলতে পারে ।
তোমাকে আমরা পনের মিনিট সময় দিলাম । চিবিয়ে চিবিয়ে বলল কথাটা । ওকে কাপড়কাচার ঘরে নিয়ে যাও । পনের মিনিট পরে নিয়ে আসবে। যদি তখনও না বলে তবে এখানেই ওকে গুলি করে মারা হবে ।
ওরা খুব ভাল করেই জানে ওরা কি করছে । একটা পুরো রাত আমি অপেক্ষা করেছি। তার পরেও আমাকে সেই ঘরে একা ফেরত পাঠাল একঘন্টা ধরে বসে থাকার জন্য, যখন আমি বুঝতে পারছিলাম টম আর যুয়ানকে ওরা বাইরে গুলি করে মারছে । আর এখন আমাকে এই কাপড়কাচার ঘরে বন্দি করে রেখেছি । ওরা এই খেলাটা রাত্রেঈ ঠিক করে রেখেছিল । নিশ্চয় নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে নিয়েছে যে এর থেকে বেশি স্নায়ুর চাপ সহ্য করা সহজ নয়, আর শেষ মেষ ওরা আমাকে পেড়ে ফেলবে ।
ওরা কিন্তু খুব ভুল করছে । ধোপাঘরে অত্যন্তে ক্লান্ত এবং শ্রান্ত আমি একটা টুলে বসে বসে চিন্তা করছিলাম । না না ভেবোনা আমি ওদের জঘন্য প্রস্তাব নিয়ে ভাবছিলাম । কারন আমি তো জানি গ্রস কোথায় আছে । শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে এক দূর সম্পর্কের ভাই এর বাড়িতে লুকিয়ে আছে গ্রস । আমি এ বিষয়েও নিশ্চিন্ত ছিলাম যে আমাকে যদিনা এরা অসহ্য স্বারীরিক নিগ্রহ না করে [ আমার মনে হচ্ছিল না যে এরা সেরকম কিছু করার কথা ভাবছে ], আমি কিছুতেই ওদের বলবনা গ্রস কোথায় লুকিয়ে আছে ।এ সবই ঠিক ঠাক করে নিয়েছি , কিন্তু আমি নিজেই বোঝবার চেষ্টা করছিলাম আমি কেন ঠিক এমনটা করবার বিষয়ে বদ্ধ পরিপক্ক । আমি মরে যাব তবু গ্রস কে ধরিয়ে দেব না । কিন্তু কেন? আমি রামন গ্রসকে তেমন কিছু ভাল বাসিনা। ওর প্রতি আমার ভালবাসা আজ ভোরেই নিঃশেষ হয়ে গেছে, যেমন শেষ হয়ে গেছে কঞ্চার প্রতি আমার প্রেম , আমার বেঁচে থাকার আগ্রহ । অবশ্যই গ্রস অনেক উচ্চ স্তরের মানুষ, প্রচন্ড শক্তি ধরে নিজের মধ্যে, এ সবই ঠিক, কিন্তু সে কারনে আমি আমার জীবন দিয়ে ওকে বাচাঁবার কথা স্থির করিনি । আমার কাছে আমার নিজের জীবনের মতন সব জীবনই সমান মূল্যহীন মনে হচ্ছে এখন । ওরা দেওয়ালের গায়ে দাঁড় করিয়ে বন্দুক চালাবে যতক্ষন না একটা জীবন শেষ হয়ে যায়, সেটা আমার জীবন না গ্রসের নাকি আর কারো, সেটাতে কোনো তারতম্য হবার কথা নয় । এটাও সত্যি যে রেমনের জীবন আমার থেকে , স্পেন এর জন্য বা এই আন্দোলোনের সাফল্যের জন্য অনেক বেশি মুল্যবান বা জরুরি – কিন্তু চুলোয় যাক স্পেন , চুলোয় যাক আন্দোলোন, আমার কাছে সব কিছুরই প্রয়োযন ফুরেয়ে গেছে কিন্তু তবু আমি এখানে বসে আছি, আমি মরে যাব তবু রেমন কে ধরিয়ে দেবনা ।
আমার নিজের কাছেই এই জিদ হাস্যকর লাগছিল । এই বোকার মতন একগূঁইয়ে পনা দেখে আমি নিজেই একটা বিকৃত আনন্দ পাচ্ছিলাম ।
ওরা এসে আমাকে আবার সেই দুজন অফিসারের কাছে নিয়ে গেল । আমার পায়ের ফাঁক দিয়ে একটা ইঁদুর ছুটে গেল দেখে আমার খুব মজা লাগল , আমি একজনের দিকে ফিরে বললাম –দেখলে ইঁদুরটাকে ?
লোকটা অত্যান্ত গম্ভীর ভাবে ছিল, কোনো উত্তর দিল না। আমার হাসি পাচ্ছিল, কিন্তু আমি নিজেকে সামলে রেখেছিলাম, কারন আমি নিশ্চিত একবার শুরু করলে আমি আর হাসি থামাতে পারবনা । লোকটার গোঁফ দেখে আমার মনে হল লোকটা শুধু শুধু চুল দিয়ে নিজের মুখ ভর্তি করছে, তাই বললাম –তোমার গোঁফ কামান উচিত । লোকটা আমাকে একটা মৃদু লাথি মারল । আমি চুপ করে গেলাম ।
তো, তুমি কি ভাবলে ? মোটা লোকটা জিগ্যাসা করল ।
আমি সকৌতুহলে লোকদুটোকে দেখছিলাম যেন খুব একটা অপরিচিত প্রজাতির পোকা দেখছি । মুখে বললাম- ও কবরখানায় লুকিয়ে আছে। কোনো সিন্দুকে বা কবরের মাটি খুঁড়ে যেখানে রাখা হয় সেই সব ঘরের মধ্যে ।
আমি মজা করছিলাম আর অপেক্ষা করছিলাম ওরা কখন উঠে দাড়িয়ে আমাকে গুলি করার আদেশ দেয় ।
লোকগুলো লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল । চল মোলেস, লেফটানেন্ট লোপেসের কাছে থেকে পনের জন সৈনিক নিয়ে নাও । আর তোমাকে বলছি শোনো- যদি সত্যি কথা বলে থাক তো তোমাকে ছেড়ে দেব। কিন্তু যদি দেখি আমাদের বাঁদরনাচ নাচাচ্ছ তবে তোমার কপালে দুঃখ আছে ।
বিরাট হৈ চৈ করতে করতে ওরা সবাই বেড়িয়ে গেল । আর আমি পরম প্রশান্তিতে দুজন রক্ষীর মাঝখানে বসে রইলাম । ওরা কি করছে ভেবে ভেবে আমি মনে মনে হাসছিলাম । আমার মনে হিংস্র আনন্দ হচ্ছিল । আমি মনে মনে কল্পনা করছিলাম ওরা একটা একটা করে কবর খুলে ভিতরে দেখছে, সিন্দুকের দরজা একটা একটা করে খুলছে , এবার মাটির ঘরগূলোর দরজ খুলছে । আমি অশরীরী আত্মা হয়ে ওদের এই নাজেহাল অবস্থা উপভোগ করছিলাম আর নিজেকে একটা নায়ক মনে হচ্ছিল । এক রক্ষীগুলো তাদের বড় বড় খুলন্ত গোঁফ নিয়ে আর ওদের ওপরওয়ালারা সেনা পোষাক পরে বাঁদর নাচ নাচছে । এটা ভীষন ভাবে আমাকে আনন্দ দিচ্ছিল ।
কিছুক্ষন পরে সেই বেঁটে লোক্টা একা ফিরে এল। আমি মনে করলাম আমাকে ক্ষতম করতে এসেছে, বাকীরা সব কবরখানায় আছে নিশ্চয় ।
অফিসারটা যখন আমার দিকে তাকাল ওকে মোটেই বোকা বোকা মনে হলনা । ওকে বাকীদের সঙ্গে বড় চাতালে নিয়ে যাও । গুলি চালনা শেষ হয়ে গেলে, একটা বিচার সভায় ঠিক হবে ওকে নিয়ে কি করা হবে ।
আমি কিছু বুঝতে না পেরে জিগ্যাসা করলাম- তার মানে ওরা আমাকে গুলি করবে না ?
আপাতত নয়। এর পরে কি হবে সেটা আমার ব্যাপার নয় ।
আমি তবু বুঝেতে পারছিলাম না- কিন্তু কেন ?
কিছু না বলে কাঁধ ঝাঁকাল। সৈন্যরা আমাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল । বড় চাতালে প্রায় শতাধদিক বন্দী দাঁড়িয়েছিল, তাদের মধ্যে অনেকেই মহিলা, শিশু এবং বৃদ্ধ । আমি ঘটনায় আকস্মিকতায় স্তম্ভিত হয়ে গেছিলাম । মাঝখানে গোলাকার ঘাস চত্বরে গিয়ে দাঁড়ালাম । দুপুরে আমাদের সৈন্য আবাসে খেতে দিল । দু-তিন জন আমার সঙ্গে কথা বলল ।আমি কোনো উত্তর দিতে পারছিলাম না । নিশ্চয় আমাকে চেনে । আমি কোথায় আছি তাই বুঝতে পারছিলাম না ।
সন্ধ্যের সময় ওরা দশ জন নতুন বন্দীকে ঠেলে দিল উঠনের মধ্যে । আমি গারচিয়াকে দেখে চিনতে পারলাম । আমি ভাবতেও পারিনি তোমাকে দেখতে পাব । খুব ভাগ্যবান বলতে হবে তোমাকে, বলল গারচিয়া ।
আমি বললাম – আমাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কেন বুঝতে পারছিনা, ওরা মত পরিবর্তন করেছে ।
গারসিয়া বলল- আমাকে আজ দুটোর সময় বন্দী করেছে ।
কিন্তু কেন? আমি অবাক হলাম গারসিয়া কখন কোনো রাজনৈতিক কার্যক্লাপের সঙ্গে যুক্ত ছিল না ।
জানিনা । যে কেউ ওদের মতে বিশ্বাসী নয় তাকেই বন্দী করছে । তারপর গলাটা নীচু করে বলল “ওরা আজ গ্রসকে ও ধরে ফেলেছে ।
আমার মাথা ঘুরে গেল – কখন ?
আজ সকালে । গ্রস বোকামি করেছে যে । ওর যে আত্মীয়ের বাড়ি থাকত তার সঙ্গে কি নাকি নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল, তাই তার বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিল । অনেক লোকই গ্রস কে আশ্রয় দিতে চেয়েছিল- কিন্তু কারো কাছে ঋনী থাকবেনা বলে বলেছিল আমি ইব্বিতার বাড়ি থাকব । তারপর যখন শুনল তোমাকেও ধরে নিয়ে এসেছে তখন গিয়ে কবরখানায় গিয়ে লুকিয়েছিল ।
কবরখানায়?
হ্যাঁ তো। কি বোকা বল, ঐ সব জায়গাতো এরা খুঁজবেই। ওরা ওখানে গেছিল আজ, আর গ্রস কে একটা কবরের মাটি রাখার ঘরের মধ্যে আবিস্কার করেছে । গ্রস ওদের দেখে গুলিও চালিয়েছিল, কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেনি । ওরা ধরে এনেছে ।
কবরখানায় ?
আমার চারপাশে সবকিছু যেন বাঁই বাঁই করে ঘুরছে আর আমি মাথা ঘুরে মাটিতে বসে পড়লাম। অট্ট হাসি হাসতে হাসতে একসময় আমার চোখ থেকে জল পরতে লাগল ।
No comments:
Post a Comment