Monday, June 27, 2011

কত দূরে গেলে পাব তোমায়

আর কত দূরে আছ তুমি
আমি কিছুটা বুঝেছি কিছুটা নয় ।
ভাঙ্গা ভাঙ্গা সিঁড়ি কতটা উঠেছে ,
কত দূরে গেলে পাব তোমায় ।

আমি চাইনা কিছুই
আমি নিজের ভাগ্য করব জয় ।
কোন পথে গেছে সবাই
যাদের বেসেছ ভালো –
কোন পথে গেলে দেখব
তারারা জ্বেলেছে আলো ।
চন্দ্র সূর্য চাইনা আমার
শুধু চাই তোমায় ।

আমি কিছুটা বুঝেছি কিছুটা নয়,
আঁকা বাঁকা পথ কতটা গিয়েছে,
কত দূরে গেলে পাব তোমায় ।

সাদা-কালো নয় পৃথিবী আমার ,
বড় রঙ্গিন ।
সেখানে দিন রাত সব একসাথে ঘোরে ,
মন্দির আছে মূর্তিহীন ।
মহাকাশ আর মহাকাল জুরে ,
ওঁকার ধ্বনি ঐ বাজে ।
বিন্দুতে আর সিন্ধুতে তুমি
সবার মাঝে ।
নিয়েছে বাসা ।
তোমার স্বপ্ন চোখে নিয়ে আজ
অনন্ত এই স্রোতে ভাসা ।

কত কাল গেলে কত যুগ গেলে
পাব তোমায় ,
আমি কিছুটা বুঝেছি কিছুটা নয় ।

প্রায়শ্চিত্ত

শীতের উত্তুরে কনকনে হাওয়া থেকে বাঁচার জন্য সুধা গরম চাদরটা ভাল করে জরিয়ে নিলেন গায় । ষাট পেড়িয়ে গেছে তবুও সৌন্দর্য এখনো ছেড়ে যায় নি ..এক মাথা কাঁচা-পাকা কোঁকড়ান চুল, আলগোছে ঘাড়ের কাছে খোঁপা করে বাঁধা ।মাঝ খানে টান টান সাদা সিঁথির রাস্তা । ছোট্ট চাঁদের মতন কপাল ।পাতলা ভ্রু যুগলের তলায় মায়া মায়া স্বপ্নিল দুটি চোখ ।সেই চোখে তিনি নিচে চেয়ে আছেন, দেখছেন কি না কে জানে, দেখলে কি দেখছেন, কাকে দেখছেন, তাই বা কে বলতে পারে । নিচে রাস্তায় কেউ হাঁটছে, কেউ দাঁড়িয়ে কথা বলছে, শিশু, বৃদ্ধ , মাঝ বয়সী । সুধা স্বপ্ন দেখেতে ভাল বাসেন, ভালবাসেন কল্পনার জগতে বিচরণ করতে । তিনি সাদা, কালো, লাল, নীল, সবুজ নানা রঙের স্বপ্ন দেখেন, সেই স্বপ্ন কে কথার মালায় সাজিয়ে সৃষ্টি করেন কবিতা, সেই সব কবিতাই ঘিরে রাখে তাঁর জগত ।
কত বছর আগে, মনে হয় বছর চল্লিশ হবে, সুধা আর বিনোদিনী এমনি এক শীতের সকালে স্কুলের পথে চলেছিলেন একসাথে । দুজনার গায়ে নীল গরম জামার তলায় সাদা স্কুল স্কার্ট , কাঁধে ঝোলান স্কুল ব্যাগে । আর দু-দিন তার পরে স্কুল ছুটি হয়ে যাবে, বড়দিনের ছুটি । সুধার মনে হল, এখনকার থেকে সেসময় অনেক বেশী শীত পড়ত। বিনোদিনী স্কুলে নতুন । তার বাবা সরকারী চাকরী করেন, নানা জায়গায় বদলি হতে হয় । অনেক বড় চাকরি করেন, অনেক ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, মানে একজন কেউকেটা ।

বিনোদিনী কিন্তু ভারি সরল সোজা আর মিশুকে মেয়ে । তার কোন অহংকার ও নেই , এই যে তার বাবা এত বড় চাকুরে । স্কুলের সব মেয়ে, মায় দিদিমণিরা পর্যন্ত বিনোদিনীর গুণমুগ্ধ । সে স্কুলে আসার পর থেকে সুধার মন বড়ই খারাপ থাকে । এতদিন সুধা পড়াশুনায় সবচেয়ে আগে, প্রতি বছর প্রতি বিষয় প্রথম হতেন । শিক্ষিকা সবাই সুধাকে খুবই ভালবাসতেন, যেমন ভাল ছাত্র-ছাত্রীর ক্ষেত্রে হয়ে থাকে আর কি । কিন্তু দেখা গেল বিনোদিনী, সুধার থেকে সব বিষয়েই এগিয়ে থাকে । পরীক্ষায় সে বছর বিনোদিনী প্রথম, সুধা দ্বিতীয় । এমন কি খেলাধুলা তেও বিনোদিনী চৌকশ । সুধা তার নিজের জায়গাটা হাতছাড়া হতে দেখে মনমরা হয়ে থাকে । যতই চেষ্টা করুক বিনোদিনীকে হারাতে পারেনা সুধা । তবে সুধার একটা গুন বা সখ, সে বেশ সুন্দর ছড়া লিখতে পারে। সবাই ভালই বলে সে সব কবিতা পড়ে। সুধার বাবা বঙ্কিম রায় মশাই একটি প্রকাশনী কার্যালয়েতে কাজ করতেন । তিনি কথা দিয়েছেন সুধার কবিতার বই ছাপিয়ে দেবেন ।

সুধা বিনোদিনী একটু অহংকারের সঙ্গেই বললেন , জানিস তো আমার বাবা বলেছেন আমার লেখা কবিতা গুল নিয়ে একটা বই ছাপিয়ে দেবেন । সেখানে আমার ছবি ও থাকবে। অহংকার তো হবার ই কথা ।

সবাই তো আর ইচ্ছা হলেই ছড়া লিখতে পারেনা । তার জন্য আলাদা এলেম দরকার । মনে মনে নিজেকে সে অন্তত এ বিষয়ে বিনোদিনীর চেয়ে একটু উপরে বলে মনে করতে পারে ।

তাই বুঝি! বিনোদিনীর সুরে কি হিংসা ছিল না কি হতাশা ! ঠিক বুঝলেন সুধা ।

জানিস তোকে বলিনি, আমিও না কবিতা লিখি । সবাই বলে বেশ ভাল লেখা । বিনোদিনী বললেন । তার পরে একটু কুণ্ঠার সঙ্গে যোগ করলেন – তোর বাবা আমার বই ও ছাপিয়ে দিতে পারবেন ভাই !

সহসাই সুধা দ্রুত পা চালালেন , হতবাক বিনোদিনী কে পিছনে ফেলে, প্রায় দৌড়ে গেলেন যেন । কেন কেন, বিনোদিনী কবিতা লিখবে । স্কুলে এসে পর্যন্ত, সব বিষয়ে সুধাকে তার অর্জিত মর্যাদার আসন থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে । লেখাপড়া, খেলাধুলা, এমনকি এখন দিদিমণিরা বি্নোদিনীকে ই ক্লাস মনিটার করেন সবসময় । তার উপর সে কবিতাও লিখবে । কেন লিখবে, সেটা শুধু সুধার জন্য থাকুক, শুধু তার জন্য । যেমন করেই হক বিনোদিনীকে কবিতা লেখা থেকে নিরস্ত করতে হবে।

স্কুলে গিয়ে সুধা মাথা ঠাণ্ডা করলে চেষ্টা করেন । বিনোদিনীর সঙ্গে যেচে কথা বলে ব্যাপারটা হাল্কা করতে চাইলেন । যেমন নিজে থেকে তার কাছে তার কবিতার কথা জিজ্ঞাসা করা , এমনকি তার কবিতার খাতাও দেখতে চাওয়া । বিনোদিনীর সরল মন, লাল রঙ এর একটা বাঁধান ডাইরি আছে তার, চারপাশটা সোনালী বর্ডার । ভিতর মুক্তর মতন গোল গোল গোটা গোটা অক্ষরে কাল কালিতে কুড়িখানা কবিতা ।

সুধা বললে, সে খাতা যদি বাড়িতে নিয়ে যেতে দিস ,আমি বাবাকে দেখাব । বাবা হয়ত তোর লেখা ও ছাপিয়ে দিতে রাজী হবেন । কি বলিস !

বিনোদিনী তো অনন্দে আত্মহারা । সত্যি ! তুই কি ভাল রে । আজ থেকে তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড । দেখিস আমার বই আমি তোকে উৎসর্গ করব ।

সুধার চিন্তা-স্রোত ছিন্ন ভিন্ন করে বেজে উঠল টেলিফোনের ক্যানক্যানে শব্দ । এই সব কথা কত দিন আগে ঘটে গেছে, কিন্তু বার বার চিন্তা করে এদের স্মৃতি ঝক ঝক করছে সুধা অন্তরে, এই তো যেন সেদিনকার ঘটনা । বার বার যাওয়া আসা করে স্মৃতির রাস্তা যেন ছবির মতন স্পষ্ট, তার প্রতি আনাচ, কানাচ, প্রতি মোড়, প্রতি ঘটনা , অঘটন। জোর করে বর্তমানে ফিরে, ভ্রু কুঞ্চিত সুধার, কে আবার এই অসময় ।

দিদু, কি করছ? সেই তোমার জানলার ধারে ? আমার পুলওভার তৈরি হল । শিলার চিল কণ্ঠ দূরে রাখার জন্য সুধা টেলিফোন কানের থেক একটু দূরে নিয়ে গেলেন ।

আঃ, আস্তে কথা বলতে পারিস না ! হাল্কা একটা স্নেহের ছায়া খেলে গেল সুধার মুখমণ্ডলে ।না রে পাগলি, এখনো জোরা দেওয়া আর বোতাম বসান ও বাকি আছে ।

ওঃ দিদু, তাড়া তাড়ি কর । পরশু আমাদের স্কুল থেকে শিমলা নিয়ে যাচ্ছে । তার আগে চাই কিন্তু ।সুধার চোখের সামনে নাতনীর দুষ্টু-মিষ্টি চেহারা টা ভেসে উঠল ।

কাল আয়, পেয়ে যাবি ।
ঠিক !
ঠিক ,

পরের দিন সকালে বিনদিনি সুধার হাতে সমর্পণ করলেন তার সাত রাজার ধন এক মানিক, তার কবিতার খাতা ।
আমি বাবার কাছে দেব ।
ঠিক তো !
ঠিক।

সেদিন বাড়ি ফিরে সুধা চুপি চুপি বাবার ঘরে গেলেন । বাবা অফিস থেকে ফেরেন নি । বাবার ঘরে লেখার ডেস্ক আছে, সেখান থেকে কাল কালির দোয়াত হাতে সুধা তার বারান্দায় বসে বিনোদিনীর সখের কবিতার ডায়রি খুলে ঢেলে দিলেন কাল কালি পাতায় পাতায় । ধীরে ধীরে কাল কাল পিঁপড়ের মতন অক্ষর সব দোয়াতের কালির সঙ্গে মিলে মিশে একাকার । একটা কালিতে চোবান ডায়রি । কার সাধ্য কোন লেখা উদ্ধার করে । কালির দোয়াত যথাস্থানে রেখে, সেদিন খুব আরামের ঘুম ঘুমলেন সুধা ।

কি বলছিস তুই ! এ হতে পারে না ।বিনোদিনীর বিস্ফারিত চোখের দিকে তাকিয়ে অনায়াসে নিজের চোখে জল এনে ফেললেন সুধা । সত্যি বলছি, তোর গা ছুঁয়ে বলছি, বিশ্বাস কর আমি ইচ্ছা করে করিনি । বাবার ঘরে ডায়রি টা রাখতে গেলাম, কে জানত বল, যে কালির দোয়াত ঢাকনা খোলা আছে । আমার নিজেকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে । আমি কত বড় ক্ষতি করলাম তোর আমার নিজেকে একটা আস্ত খুনি মনে হচ্ছে। সুধার সুন্দর নিষ্পাপ মুখ দেখে কি কেউ বুঝবে, সে কতবড় মিথ্যাচার করছে । বিনোদিনীর নরম মন, সে নিজের দুঃখ ভুলে সুধা কে সান্ত্বনা দেয় । নারে তোর কি দোষ, এরকম তো হতেই পারে । সেদিন বিনোদিনী কিছুতেই কোনও বিষয়ে মন দিতে পারলেননা । যখন অঙ্কের দিদিমণি একটা শক্ত অঙ্ক দিলেন যেটা কেউ পারলনা, রোজকার মতন বিনোদিনী নিজে গিয়ে সে অঙ্ক সমাধান করার কথা ও বললেননা । সবাই খুব অবাক। বাড়ি ফিরে বিনোদিনী ঘরে ঢুকে সটান খাটের উপর আছাড় খেয়ে পড়লেন, সে কি কান্না তার। সুধা পরে জেনেছিল, বিনোদিনীর মা মেয়েকে কে আবার মনে করে করে লিখতে সাহায্য করেছিলেন । তিনি তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বুঝিয়েছিলেন, এটা তোর সামনে একটা পরীক্ষা মা, তুই চেষ্টা কর আবার তুই লিখতে পারবি। এত সহজে হার মেনে নিতে নেই জীবনে । জীবন লড়াই করে জিততে হয়।

বল হরি হরি বোল, বল হরি হরি বোল, দূর থেকে মৃতদেহ নিয়ে কাঁধে নিয়ে আসছে চার জন, তাদের পিছন পিছন আরও লোক জন খই ছড়াতে ছড়াতে যাচ্ছে। দূর থেকে কাছে এসে আবার দূরে মিলিয়ে গেল শবযাত্রা, ছড়িয়ে দিয়ে চলে গেল ধুপের তীব্র গন্ধ । এমন কি দোতলার জানলায় বসে সে গন্ধ এড়াতে পারলেন না সুধা ।

বল হরি হরি বোল বল হরি বোল, স্তব্ধ সুধার জীবন শূন্য করে মামা, কাকারা , বাবার মৃত দেহ, নিয়ে চলে গেল । সেদিন টিফিনের পরে সুধাকে বাড়ি নিয়ে এলেন শেখর কাকা। কেন তারা বাড়ি যাচ্ছে এত তাড়া তাড়ি, সুধা বার বার জিজ্ঞাসা করলেও কিছু তেই উত্তর পেলেননা । সেদিন রোজকার মতন খেয়ে দেয়ে অফিস যাবার জন্য বেড়িয়েছিলেন বঙ্কিম রায় মশাই । বাস স্টপে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মাথা ঘুরে পড়ে যান সেখানে । পাড়ার লোক চিনতে পেরে ধরাধরি করে বাড়িতে আনে, ডাক্তার ডাকে, কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ । মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে সম্পূর্ণ অনাথ হয়ে গেলেন সুধা ।বাড়িতে গিয়ে দেখেন উঠোনের উপর বাবার দেহ সাদা চাদরে ঢাকা । কেউ সুন্দর করে বাবার কপালে চন্দন পড়িয়ে দিয়েছে । দুখানি পা চাদরের তলা দিয়ে বেড়িয়ে রয়েছে । কেউ একজন সুধা কে নিয়ে এগিয়ে গেল- বাবাকে শেষ বারের মতন নমস্কার কর সুধা । সুধা বাবার পায়ে হাত ছুঁইয়েই চমকে হাত সরিয়ে নিলেন । বরফের মতন ঠাণ্ডা । বাবাকে যখন ওরা নিয়ে যাচ্ছে সুধার মনে হল তার জীবন শূন্য হয়ে গেল । এখন তার চোদ্দ বছর বয়স । মা তাকে জন্ম দিয়েই মারা ছেড়ে গেছেন, একবার চোখের দেখাও দেখেনি দু-জনে দুজনকে। বাবাই তার জীবনে সব , আর আছেন ঠাকুমা । ওরা যখন বাবা কে কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে, সুধার মনে চট করে একটা চিন্তা এলো, তার কবিতার বই আর কোনও দিন ছাপা হবে না । ঠাকুমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল সুধা ।

নিচে তাকিয়ে সুধা দেখেন পোস্টম্যান । দ্রুত পায়ে নিচে গিয়ে বাক্স থেকে চিঠি বার করলেন সুধা । সাদা লম্বা খামের ওপর তাঁর নিজের হাতে লেখা ঠিকানা, সুধারানী রায় বর্মন, ১৫ বকুল বাগান রোড, কলকাতা ৭০০০১৭ । খাম খুলে চিঠি পড়ে সুধার মুখে একটা বিচিত্র হাসি খেলে গেল । দু লাইনের চিঠি । প্রতি বার কবিতা লিখে প্রাকাশক/ সম্পাদকের কাছে পাঠানর সময় নিজে হাতে একটা সাদা খামে নিজের ঠিকানা লিখে পাঠাতে ভোলেন না সুধা ।

“প্রিয় সুধারানী দেবী, আমরা দুঃখিত আপনার কবিতা আমরা আমাদের পত্রিকায় ছাপাতে অপারগ । আমরা আশা করি ভবিষ্যতে ............ইত্যাদি”

উপর গিয়ে বাবার সেই পুড়ান দেরাজ খুলে চিঠিটা রাখলেন; একরাশ চিঠি পড়ে রয়েছে সেখানে, এমনই প্রত্যাখ্যানের চিঠি । সুধার প্রায়শ্চিত্তের চিঠি ।

এবার সুধা রোজকার অভ্যাস মত জানলা বন্ধ করে চেয়ারে বিনোদিনির নতুন লেখা কবিতার বই খুলে বসলেন । প্রায় প্রতি বছর বিনোদিনীর লেখা কবিতার বই প্রকাশ হয় নামকরা প্রকাশকের ছত্রছায়ায় ; আর প্রকাশ হওয়া মাত্র সে বই সুধারানী সংগ্রহ করেন নিজের তাগিদে ।

Thursday, June 16, 2011

বাসা

বাসা

জুন মাসের সাত তারিখ হয়ে গেল , আকাশ গন গনে আগুনের মতন হয়ে আছে । বৃষ্টির কোনও চিহ্ন নেই । ভ্যাপসা দম বন্ধ করা গরমে ঘেমে বাস থেকে নেমে একটা আপাত স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম । যাদবপুর –গড়িয়া এলাকা টা আমার তেমন চেনা নেই । গত মাসে এসেছিলাম বাসা ঠিক করতে, তাই আন্দাজে নেমে পড়লাম । না: ভুল করিনি , বড় রাস্তা পার করে ডান দিকের গলিটাই রবি চ্যাটার্জ্জি লেন । এ রাস্তার শেষে ২৭ এ, নম্বর বাড়িটাই’ ‘শান্তির নীড়- আদর্শ বৃদ্ধাবাস । বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম । গতমাসে ভাল করে দেখা হয়নি । বাড়িটা বাইরে থেকে দেখলে একটা দেশলাইয়ের খোলের মতন মনে হয় । রঙ একটা কোনও সময় ছিল হয়ত এখন কিছু বোঝার উপায় নেই । ভিতরের দৈন্যদশা বাইরে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল । বুকে একটা ভার নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম ভিতরে । ফুটপাথ থেকেই উঠেছে ভিতরে যাবার দুটো সিঁড়ি, সদর দরজা খোলাই ছিল । ভিতরে ঢুকে, বাঁদিকে অফিস ঘর , একটা ভাঙ্গা টেবিল, চেয়ার জুরে বসে আছেন যিনি, তাকে দেখলে হটাত চমকে উঠতে হয় । এই জরাজীর্ণ পরিবেশে অনেকটাই বেমানান শ্রীমতী রেবা রায় , শান্তির নীড়ের কেয়ার টেকার । মহিলার বয়স চল্লিশের ওপারেই হবে, কিন্তু এখনো স্বাস্থ্য অটুট, মুখে আপ্যায়নের হাসি, পরিপাটি বেশ-বাস । এগিয়ে গিয়ে নমস্কার সেরে খাতায় সই করলাম । তার পরে কড়কড়ে চার হাজার টাকা গুনে ক্যাশ বাক্সে রেখে, রিসিট কেটে দিলেন । আমি মৃদু হেসে ঘর থেকে বেড়িয়ে এগিয়ে গেলাম পাঁচ নম্বর ঘরের দিকে । এদের এখানে মোট পনের জন বাসীন্দা আছেন । একটা ঘরে একজন, দু-জন বা চার-জন, এই ভাবে ভাগ করা । আমার মা একা ঘরে থাকেন । তার কারন চার জনের ঘর খালি নেই, আর এখানকার মালিক, খালি একজনের ঘর চারজনার ঘরের দামে আপাতত একজন কে ভাড়া দিয়েছেন ।

ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে গুছিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। ঘরের ভিতর একটা চৌকি, তাতে বিছানা , বালিশ পাতা । পাশে একটা কাঠের চেয়ার, একটা টেবিল, তাতে জলের জায়গা, গ্লাস আর কিছু টুক টাক জিনিষ , কোনের দিকে দেয়ালে পেরেক মেরে বাঁধা দড়িতে কাপড় ঝোলান, বুঝলাম এটা আলনার কাজ করছে । ঘরের ভিতর ঘুমোট গরম । দেয়ালের চুন খসে পড়েছে, কাঠের জানলা বন্ধ, উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম পাখাটা এত আস্তে চলছে যে হাওয়া নেই বললেই চলে।

মা বলল – রেগুলেটর খারাপ আছে, তুই জানলাটা খুলে দে , যাবার সময় বন্ধ করে দিস, সন্ধে হলেই ঝাঁক ঝাঁক মশা ঢুকবে ।

মা কাপড়টা দেখে মনে হল কত দিন কাচা হয়নি । বিছানার চাদর নোংরা, মাথার বালিশ তেল চিটে । আমার বুকের ভিতর টা চাপ চাপ লাগছিল । মা কেমন হাসি খুশি ছিল, একমাস আগেও । কি ফিটফাট, ধপধপে সাদা শারি । পরিপাটি চুল বাঁধা । বিছানা নিয়ে মা খুবই পিটপিটে বরাবর, চাদর, বালিশের ওয়ার, কাঁথা, কাচা ধোয়া ইস্তিরি করা না হলে মার ঘুম হতনা ।

কিন্তু আমার নিজের যা সামর্থ্য মা কে এর থেকে ভাল যায়গায় রাখতে পারবনা । যা মাইনে পাই, তার থেকে সংসার খরচ, মিনির স্কুলের খরচ, শিলার হাত খরচ, আর আমাদের নতুন কেনা বহুতলের ফ্ল্যাটের মাসের ইনস্টলমেন্ট দিয়ে আর যা বাকী থাকে তার থেকে এর থেকে দামী যায়গায় মাকে রাখা যেত না ।


আমি চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে পড়লাম । কি যে কথা বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না । মা জিজ্ঞাসা করল- কেমন আছিস ? মাথা নাড়লাম । তোর বৌ ? এবার ও মাথা নাড়লাম । মা কখনো শিলা কে নাম ধরে উল্লেখ করে না- সব সময় বলবে ‘তোর বৌ’ আর তাতেই শিলা ক্ষেপে লাল । মা আর শিলার এই ঝগড়ার বলি আমি । দু-জনার কাউকেই বোঝাতে পারলাম না শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা । মা বলবে ‘তোর বৌকে বোঝা । শিলা বলবে তোমার মাকে সহ্য করা যায় না । শেষ সে বেঁকে বসল, হয় মা না হয় আমি । তো আমি বললাম তুমি, কারণ আমি তো জানি, মা কে সরিয়ে দিলেও মা আমারই থাকবে । মা যে আমার একার মা, আমাকে ত্যাগ করবে না । মার জন্য বৌকে ছাড়া যায় না, নিজের মেয়েকে ছাড়া যায় না । অতএব ‘বৃদ্ধাবাস ‘।

মিনি কেমন আছে রে? ওকে নিয়ে এলে পারতিস , দেখতাম । মিনির কথা বলবার সময় মার শুকন, কঠিন মুখে একটা চাপা খুশীর ছায়া খেলে গেল । চোখদুটো স্বপ্নালু হয়ে উঠল । মিনি , আমার ছয় বছরের মেয়ে, দাদি বলতে অজ্ঞান । স্কুল থেকে ফিরেই দাদি, বকলে দাদি, রাত্রে দাদির কাছে না শুলে তার ঘুম হয়না, দাদি গল্প বলে যে । ও রকম গল্প মা বলতে পারেনা যে । যখন নাতনি আর দাদি গল্প করত মনে হত দুটি সম বয়সী বন্ধু যেন ।
এতে ও শিলার ভীষণ আপত্তি । মিনির কু-শিক্ষা হচ্ছে । এখন মিনির স্কুলের গরমের ছুটি, কিন্তু কাল শিলা মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে । এছাড়া কি বা উপায় । আমরা কি বলতে পারব কোথায় রেখে এসেছি তার দাদিকে । বলতে হয়েছে বেড়াতে গেছে খুব সুন্দর জায়গায় নিজের বন্ধুদের সংগে ।

সেকি দাদির নিজের বন্ধুও আছে । কৈ দেখিনি কেন কোনদিন ? কবে আসবে বাবা ? আমাকে কেন নিয়ে গেলনা ?

আছে বৈকি, তুই দেখিস নি । তোকে কি করে নিয়ে যাবে, তোর স্কুল না ! দিদিমণি বকবে যে । আসবে আসবে , এই তো কিছু দিন পরেই আসবে । মিথ্যা মিথ্যা আর মিথ্যা । কি জানি কত দিন চালাতে পারব এ ভাবে । শিলা বলে কিছুদিনেই ভুলে যাবে দাদিকে , শিশু তো , ওদের মনে থাকেনা । তাই তো , ঘরের কত পুড়ান আসবাব ফেলে নতুন নতুন কেনা হয়েছে ; সেই রকম পুড়ান দাদি সরিয়ে নতুন দাই-মা রাখা হয়েছে, যে গল্প বলে, স্নান করিয়ে দেয়, খাইয়ে দেয়, সব করে । পুড়ান ভাড়া বাড়ি ছেড়ে নতুন কেনা ফ্ল্যাটে এসেছি । একটা বড় ঘর, সেটাকে দিব্যি একটা কাশ্মীরি কাঠের পার্টিশন করে একপাশে সোফা সেট অন্য দিকে খাবার টেবিল পেতেছে শিলা । আরও দুটো ঘর আছে, তার সঙ্গে জোরা স্নানঘর ।একটা আমাদের, আর একটা মিনির ।হ্যাঁ ছোট্ট মিনির জন্য একটা আস্ত ঘর চাই, সংগে দাদি থাকলে চলবেনা । অভ্যাস খারাপ হয়ে যাচ্ছে । আর শিলার দৃঢ় বিশ্বাস মা সবার আড়ালে মিনির মনে নিজের মায়ের বিরুদ্ধে বিষ ঢোকাচ্ছে । পুড়ান বাবার আমলের আসবাব বিক্রি করে নতুন কেনা হয়েছে ।পুড়ান টিভি পালটে নতুন এল সি ডি টি ভি, নতুন পরদা, এক একটা ঘরে এক এক রকম রঙ, তাদের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে পরদা । আর আমি নামক পুড়ান ছেলেটা, এখন নতুন কেন্নো জন্ম লাভ করেছি , স্বামী হিসাবে ।

আমি কথা ঘোরাবার জন্য বললাম, তুমি কেমন আছ মা? তোমাকে দেখে ভাল লাগছেনা ? কত রোগা হয়ে গেছ এক মাসে। খাওয়া দাওয়া ঠিক হচ্ছে তো ? মা একথার কোনও উত্তর করলনা ।শুধু একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বেড়িয়ে এলো। কিছুক্ষণ নিঃস্তবদ্ধতায় কেটে যায় ।


শিলা কিছু জিনিষ রেখে গেছিল মার জন্য, বিস্কুট, মাথার তেল, আর কি কি, সে সব আমি টেবিল এ রেখে উঠে দাঁড়ালাম । মা বলল এখুনি যাবি ? আমি বললাম হ্যাঁ মা, পরের মাসে সময় নিয়ে আসব , আজ চলি । মা বলল –এখুনি যাবি? আচ্ছা আয় বাবা , দুর্গা দুর্গা । রাস্তা দেখে পাড় হবি । সাবধানে যাস, আর হ্যাঁ চলন্ত বাস থেকে নামিস না যেন ।


উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আমার হটাত মনে পড়ে গেল মিনি মামার বাড়ি যাবার আগে একটা খাম দিয়ে গেছিল দাদির কাছে পাঠাবার জন্য ঠিকানা লিখে ডাক বাক্সে ফেলতে। আমি বাগ খুলে খামটা খুলে দেখি একটা হাতে তৈরি কার্ড । দুটো লাল ফুল, দুটো সবুজ পাতা, মিনির নতুন রং-তুলির কাজ, ভেতরে কচি হাতে লেখা,

দাদি- তুমি শীগগির চলে এস-
তোমার জন্য আমার ভীষণ মন কেমন করছে

তোমার আদরের মিনি

আমি কার্ডটা মার হাতে দিলাম –

মার চোখ থেকে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে । দেখে আমার ভিতরের ছেলেটা জেগে উঠল । এই আমার মা, সারা জীবন বুক দিয়ে আমায় আগলেছে । বাবা মারা যাবার পরে একা হাতে সব বাধা পেড়িয়ে আমাকে এত বড় করেছে । আজ বৃদ্ধা, অসহায়,
পরিত্যক্ত আসবাবের মতন এখানে আমার সামনে । আমি হাত বাড়িয়ে মার হাতটা ধরে- বললাম ‘মা চল আমি তোমাকে নিতে এসেছি । আর এখানে তোমাকে থাকতে হবে না‘।

আমি বললাম কি? না কারণ একথা ভাবার সঙ্গে সঙ্গে আমার ভিতরটা কেন্নোর মতন গুটিয়ে গেল, আমার জিভ আড়ষ্ট , আমার ভিতর থেকে কে যেন আমাকে ঠেলে বাইরে বাড় করে আনল । আমি ছিটকে রাস্তায় বেড়িয়ে এসে পিছন ফিরে দেখলাম একবার । সরু বারান্দায় বসা কিছু বৃদ্ধ, বৃদ্ধা সাগ্রহে আমার দিকে দেখছেন । ভাবছেন তাদের ছেলে বুঝি, মাসের দেখাটা সারতে এসেছি ।

আমি আমার নতুন ঝকঝকে ফ্ল্যাটের কথা ভাবছিলাম, নতুন, সুন্দর, ঝাঁ চক চকে , কিন্তু সেটা কে কি বাসা বলা যায় !

Monday, June 13, 2011

গন্তব্য

গন্তব্যের গভীরে ঢুকে পড়েছে ধূলা বালি ।
আমি বৃথা পথ চলি
সুখের আশায় ।
ঐ দূরে ঐ দিগন্ত রেখায়
দেখা যায় সুর্য অস্তগামী ।
পিছনে এসেছি ফেলে যা কিছু
বেসেছি ভালো, যত কিছু দামী ।
আজ মনে হয় ,
যে পথ ধূলায় ভরা , বালিময় সাহারায় টানে ,
কেন আমি চলেছি সে পথে ,
ফেলে রেখে জীবন সুন্দর ,

জীবন-যৌবন তোর থাকুক তফাতে ;
মরণ যে চির সাথী তোর –
বলে গেলে তুমি কানে কানে ।

Sunday, June 12, 2011

আমি বন্য আদিম মানবী

আমি যদি হতাম লাবণ্য-
তোমায় দেখে সাউথ সিটি মলে
শেলী, কিটি বা মিলির সাথে ,
কাফে-কফি-ডে-র চেয়ারে আড্ডারত –
চেয়ার টেবিল উলটে
কলার ধরে তোমায় টেনে আনার
ইচ্ছে টাকে বুকের মাঝে চেপে –
অনায়াসে এগিয়ে যেতাম ঠোঁটের কোনায়
শ্লেষের হাসি ঝুলিয়ে ।

যদি আমি লাবণ্য হতাম,
তোমার ঘৃণিত সহবাস
শেলী, কেটি বা মিলির সাথে
আমার বিদ্রূপের বন্যায় ভাসিয়ে –
আমারদের ‘অমর-প্রেম’ ফ্রেমে বন্দী
মনের মণিকোঠায় রাখতাম ঝুলিয়ে ।

কিন্তু আমি নই লাবণ্য-
আমি বন্য
আমি হিংস্র আদিম মানবী ।
তোমার সকল বিথ্যাচার
তছ-নছ করে –
তোমার অসহনীয় উন্নাসিক চরিত্র কে
ছিন্ন-ভিন্ন করে
ছড়াব আকাশে ।
কারন আমি নই প্রেমের কবিতা
আমি নই বন্যা, মিতার ।
আমি বন্য, আদিম মানবী ।

Sunday, June 5, 2011

আনন্দধারা

তোমরা ভুলকে দেখ , কষ্টকে লেখো ,
সে সব তোমাদের প্রিয়কে ঘিরে থাকে ।
একটা জন্মে এত ভুল করে মানুষ
এত কষ্ট পায় – তবু ভালবাসে তাকে ।
যাকে হয়ত তারা মনে করে
মনের মতন – যার কাছে-দূরে ,
মন ঘোরে সারাক্ষন ।যার আঙুল
লাট্টুর মতন ঘোরায় তাকে ।

তোমাদের কাছাকাছি আমিও ছিলাম
কোনোদিন । আমিও দিয়েছি ঢেলে
মন-প্রাণ সবই । বুঝিনি প্রাণের কোনে ,
আমার ঈশ্বর বসে চোখ মেলে ,
আমারই অপেক্ষায় –আমি
কি করে ভুলেছি তাকে ।
যে প্রেম পবিত্র তার অপমান
সয়না আমার । ততটুকু দেব ভালবাসা
যার প্রতিদান পাব ।
কষ্ট যা দেবে লোকে তাকে
পলকে ভুলাব । আমি সৃষ্টি ঈশ্বরের
অসীম অনন্ত প্রান থেকে –
এক কনা জগতে এসেছি ।
অফুরান প্রেম স্রোতে –
আমি যে ভেসেছি ।

তোমরা ভুলকে দেখেছ
ভুল করে । একবার সত্যকে দেখ ।
কষ্ট পেয়েছ যতবার –
ততবার অনন্দকে ডাক ।।

Saturday, June 4, 2011

সুখের কান্না

সুখের কান্না

এই মেয়ে কানছিস কেনরে ! শুধু শুধু চোখে জল আমি দেখতে পারিনা , মোছ শীগগিরি , পা দাপিয়ে মাসি নিজের কাজে ফিরল । আমি বলতে চাইলাম, মাসি দেখ চেয়ে জানলার বাইরে, এখনো বিকেলের আলো ভরে রয়েছে চারধার, কেমন মন কেমন করা গোলাপী আর সোনালি মেশান আলো , তার পিছনে দেখ ঐ যে আকাশের গায়ে আবছা একটা রামধনু, দুপুরে হাল্কা বৃষ্টি হল যে , আমাদের বাড়ির নিচে বকুল গাছের গায়ে পাখিরা সব ডাকা ডাকি করছে, এমন সব দেখলে চোখে জল আসবেনা ; কিন্তু বলতে পারলাম না ; বললেই তো বলবে ন্যাকামী ।

বকুল এত সুন্দর গন্ধ কোথা থেকে পেল , মাসির গায়ে শুধু ঘেমো গন্ধ । অথচ ছোট্ট মিন্তু, মাসির দেড় বছরের ছেলেটার গায়ে ঠিক এমনি সুন্দর একটা গন্ধ পাই । ভালবাসার গন্ধ , সারল্যের গন্ধ, ভগবানের গন্ধ । যেই ভাবা ওমনি আমার গলাটায় ব্যাথা ব্যাথা, চোখের কোলে জল এসে গেল । ভারি মুশকিল, কেন যে আমার এমন হয়, সুন্দর গান, সুন্দর ছবি, যা কিছু সুন্দর , যা কিছু ভাললাগার, সে সব দেখে আমার মনে কেমন একটা আনন্দ মেশান দুঃখ এসে যায়, আর আমি লোকের চোখের আড়ালে গিয়ে চোখ মুছি । কেন যে কেউ বোঝেনা এটা আমার ভাল লাগার কান্না ।

মাসি খুব গান শুনতে ভালবাসে, ঘুরে ঘুরে কাজ করে আর আর ডিভিডি চালিয়ে গান শোনে । এক্ষুনি সেই গানটা হল, শুনলেই আমার মন কেমন করে ওঠে, ঐ যে ‘বড় আশা করে এসেছি গো কাছে ডেকে ...’ । বা আরেকটা গান ‘কাড়ার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট...।‘ বার বার শুনতে ইচ্ছে করে । গানটা শুনতে শুনতে আমার বুকের মধ্যে কি যেন গুটলি পাকিয়ে গেল, আর আবার সেই জলটা চোখের কোনায়...কোথা থেকে যে আসে জল গুল- সেটা ও একটা আশ্চর্য ঘটনা । বুঝে পাইনা ছাই । আজ আমার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বেড়বে । কি জানি কি হয় ।

ওমা কে রে? চেয়ে দেখি মাসির কুকুর টুকুস, আমার মুখের দিয়ে তাকিয়ে জ্বল জ্বল চোখে বসে আছে, আর মাঝে মাঝে ধমক দিচ্ছে – ভেউ...কি হয়েছে ? তুই সব বুঝতে পারিস , নারে কুটুস , মাসি ও বোঝেনা , কিন্তু তুই ঠিক আমার মনের কথা বুঝিস । উত্তরে কুটুস দাঁড়িয়ে আমার কাঁধে তার থাবা দুটো তুলে দিল- তার পরে কত যত্ন করে লম্বা একটা জিভ বার করে আমার চোখের জল চেটে চেটে মুছে দিল । এবার সত্যি সত্যি কান্না এসে বুকে বাসা বাঁধল আমার, আজ শেষ দিন- বাবা এসে নিয়ে যাবে কাল । তোকে ছেড়ে কি করে থাকব রে কুটুস , তোকে যে সত্যি বড্ড ভালবাসি রে । আর তক্ষুনি বুঝতে পারলয়াম, একই চোখের জল, তবু দুঃখের কান্না আর সুখের কান্নার কত তফাত ।

তোমার ছোঁয়া

এখন রাতের ভোর
তারারা একে একে যাচ্ছে ঘুমের দেশ ।
পাখির সাথে সাথে
ডানা ঝাপটায়ে জাগছে শহর ।
এখনো আমার ভাঙেনি ঘুমের রেশ ।
আকাশে সোনা আলো
কোনও তারা এখনো উঁকি মেরে যায় ।
আমার শরীর-মন
তোমার ওমেতে মাখো মাখো ।
এখনো তোমার গন্ধ আছে বিছানায় ।
চুরি করে গেলে যে মাহেন্দ্র ক্ষণ
জীবনের ভোরে ,
আমার রোমে রোমে তার আহ্বান ।
এখনো রয়েছে ঘিরে ।
এখন রাতের শেষে
পৃথিবী জাগে ছেড়ে ঘুমের দেশ ।
আমি জীবন ভর আছি প্রতীক্ষায়
নিয়ে তোমার আবেশ ।।

Thursday, June 2, 2011

আমার মানসী প্রতিমা

পিছনে যত দূর মন যায় –
ততদূর চোখ ,
অনুভবে ফিরে ফিরে যাই ,
এ গলি ,সে গলি হাতড়াই ,
তুমি ভাব এ আমার মনের অসুখ ;
তুমি তো জানোনা
কে যেন আমায় রোজ –
পিছু থেকে ডাকে ,
কি যেন বলতে চায় –
হয়নি তা শোনা ।
অতীতের জানালা দিয়ে –
উঁকি মেরে যায় ,
ছুঁয়ে যায় মন ,
কে ঘোরে আমার সাথে ছায়ার মতন ।
সে আমার মানসী প্রতিমা
আমার প্রথম প্রেম আমার রচনা ;
ধীরে ধীরে হাড়িয়ে গেছিল
জীবনের ভীরে ,
সে আমার, মনের আয়নায় –
হাতছানি দিয়ে ডাকে ,
কত যত্নে লালন করেছি তাকে
অন্তরের অন্তঃপুরে
সকলের চোখের আড়ালে ।
তারপর কেটে গেছে কত যুগ-
ভুলে গেছি আমার আমিকে ,
আজ সে একাকীনি, ছিন্নমুল
ডাকে বার বার-
কি চেয়েছ হতে ,আর কি হয়েছ আজ ।
দেখ একবার,

Wednesday, June 1, 2011

চিন্তা

বৌদিমনি, মেয়ের আমার বিয়ে ।
ছেলে কলের মিস্ত্রী, ভালই রোজগার ।
যদিও টাকা চায়নি তারা
তবুও কাজে ভালই খরচ হবে ।
উতরে যাবে, যদি তোমরা দাও
কিছু টাকা ধার ।

মনে মনে শিউড়ে উঠলাম
এ আবার কি জ্বালা ।
ধার দিই আর
তাই নিয়ে তুই পালা ।

মুখে বললাম বাহ বাহ
বেশ কথা ।ধার চাইছ, এ আর এমন কি!
কিন্তু মেয়ে আমার বিদেশ যাবে
পড়বে সেখানে, তার যে অনেক ফি ।
অনেক টাকার ব্যাপার ।
ইচ্ছে থাকলেও পারবনাকো বাপু, তোমায় দিতে ধার ।

করুন মুখে করছে বাড়ির কাজ ,
চিন্তা চোখে –মুখে ,
বাপ মরা এক মেয়ে ,
কেমন করে বিয়ে যে দেয় ওকে ।
টাকার জোগার নেই,
নেই কোনো সম্বল ।
ডেকে বললাম ও বৌ দাও
দেখি ফ্রিজের থেকে একটু ঠান্ডা জল ।

তার জীবনে সবটুকু বঞ্চনা ,
দুঃখ, কষ্টে ভরা ,
আমার চিন্তা কেমন করে এড়াই
তার, টাকাটা ধার করা ।।